- বইয়ের নামঃ নীল মানুষ
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
দরজা ধরে কে যেন দাঁড়িয়েছে
দরজা ধরে কে যেন দাঁড়িয়েছে।
ফরহাদ উদ্দিন বসে আছেন খাটে। তাঁর পিঠ দরজার দিকে তবু তিনি স্পষ্ট বুঝলেন তার পেছনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। তিনি খুবই অবাক হলেন চোখে না দেখেও কী করে বোঝা যাচ্ছে? এমন তো না, যে দাঁড়িয়ে আছে তার ছায়া এসে ঘরে ঢুকেছে। কিংবা সে শব্দ করছে, নিঃশ্বাস ফেলছে। তিনি নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ শুনছেন। তিনি কিছুই শুনছেন না। যে দাঁড়িয়ে আছে তার গায়ের গন্ধও পাচ্ছেন না। কারণ ফরহাদ উদ্দিন সাহেবের ঘ্রাণশক্তি নেই। গত পনেরো বছর ধরে তিনি কোনো কিছুর গন্ধ পান না। একবার কাগজি লেবু চিপে তার কিছু রস তিনি নাকের ফুটোয় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। নাক জ্বালা করেছে, তিনি কোনোই গন্ধ পান নি।
একজন কেউ তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি তাকে দেখছেন না, তার গায়ের কোনো ঘ্রাণ পাচ্ছেন না। সে কোনো শব্দও করছে না, অথচ ফরহাদ উদ্দিন সাহেব তার অস্তিত্ব টের পাচ্ছেন।
তার কাছে এই ঘটনার জন্যে জগৎ খুব রহস্যময় মনে হলো। ফরহাদ উদ্দিনের কাছে মাঝে মাঝে অনেক তুচ্ছ কারণেও জগৎ রহস্যময় মনে হয়। আজকের কারণটা তেমন তুচ্ছ না।
ফরহাদ উদ্দিনের হাতে খবরের কাগজ। আজ ছুটির দিন। তিনটা বাজে। খবরের কাগজ সকালেই পড়া হয়েছে। এখন আবারো পড়ছেন, কারণ তিনি লক্ষ করেছেন খবরের কাগজ দ্বিতীয়বার পড়ার সময় অনেক ইন্টারেস্টিং খবর চোখে পড়ে যা প্রথমবারে চোখ মিস করে যায়। এই যেমন এখন তিনি দারুণ ইন্টারেস্টিং একটা খবর পড়ছেন। সকালবেলা এই খবর চোখেই পড়ে নি—কাঁঠাল খেয়ে একই পরিবারের সাত জনের মৃত্যু। নিজস্ব সংবাদদাতা গাইবান্ধা থেকে জানিয়েছেন গাইবান্ধার রসুলপুরের জনৈক মজনু মিয়ার পরিবারে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। মজনু মিয়া সকালে নিজের বাড়ির পেছনের কাঁঠাল গাছ থেকে একটা পাকা কাঁঠাল পেড়ে এনে সবাই মিলে আরাম করে খেয়েছে। খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই রক্তবমিএবং মৃত্যু।
আশ্চর্যজনক সংবাদ বটেই৷ বৃক্ষের ফল কি বিষাক্ত হতে শুরু করেছে? টিউবওয়েলের বিশুদ্ধ পানিতে এখন আর্সেনিক। গাছের ফলফলাদিতেও কি আর্সেনিকের মতো বিষাক্ত কিছু জমতে শুরু করেছে? শেষ বিচারের দিন কি কাছে এসে গেছে? শেষ বিচারের দিনকাছাকাছি চলে এলে অদ্ভুত অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটবে। মাটির নিচ থেকে একটী বিকটাকার কুৎসিত প্রাণী বের হয়ে মানুষের ভাষায় কথা বলবে, গাছের ফলফলাদি বিষাক্ত হয়ে যাবে, পানির মধ্যে চলে আসবে তিক্ত স্বাদ…।
ব্যাপারগুলি নিয়ে কারো সঙ্গে আলাপ করতে পারলে হতো। দরজা ধরে যে দাঁড়িয়ে আছে তার সঙ্গে আলাপ করা যায়। ফরহাদউদ্দিন এখন জানেন কে দাঁড়িয়ে আছে—কনক। মেয়েটার চুপি চুপি দরজা ধরে দাঁড়ানোর অভ্যাস আছে। পাখি স্বভাব মেয়ে। পাখি যেমন জানালায় বসে থাকে, কেউ তার দিকে তাকালেই উড়েযায়–কনক মেয়েটাও সেরকম। ঘাড় ঘুরিয়ে ফরহাদ উদ্দিন তার দিকে তাকালেই সে সরে যাবে। তবে একেবারে চলেও যাবে না। দরজার আশেপাশে কান পেতে দাঁড়িয়ে থাকবে।
কনক ফরহাদ উদ্দিনের বন্ধু বদরুল পাশার মেয়ে। এক মাস হলো মেয়েটা এই বাড়িতে আছো আঠারে উনিশ বছরের মেয়ে অথচ শিশুদের মতো ভাব ভঙ্গি। পাখি স্বভাবের মেয়ে এরকম হয়, কিছুতেই তাদের শৈশব কাটে না। মেয়েটার উপর ফরহাদ উদ্দিনের খুবই মায়া লেগে গেছে। আর মায়া এমন জিনিস একবার যদি লেগে যায় তাহলে সর্বনাশ, মায়া বাড়তেই থাকে।
কনক
জি।
সঞ্জু বাসায় আছে কিনা একটু দেখে আস। তাকে নিয়ে এক জায়গায় যাব। ঠিক সাড়ে তিনটার সময় বের হবো। তাকে মনে করিয়ে দিয়ে আস।
ফরহাদ উদ্দিন লক্ষ করলেন মেয়েটা যাচ্ছে না। এখনো দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। থাকুক দাঁড়িয়ে। তিনি খবরের কাগজে মন দিলেন। এখন পড়ছেন কর্মখালি বিজ্ঞাপন। তার কর্মখালি বিজ্ঞাপন পড়ার কোনো কারণ নেই। তবু কেন জানি এই বিজ্ঞাপনগুলি পড়তে ভালো লাগে। তার প্রয়োজন না থাকলেও সঞ্জুর প্রয়োজন পড়বে। ছমাসের ঘধ্যে তার রেজাল্ট হয়ে যাবে। চাকরি খোঁজা শুরু। চাকরির বাজার কেমন–আগেভাগে দেখা থাকলে ভাল।
কনক
জ্বি।
দেখি মা আমাকে এক কাপ চা খাওয়াও তো।
আচ্ছা।
চিনি দিও না কিন্তু। আমার ডায়াবেটিস মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেছে। চিনি খাওয়া আর বিষ খাওয়া আমার জন্যে একই। এক চামচ চিনি মানে এক চামচ বিষ।
কনক এখনো দাঁড়িয়ে আছে। আজ মনে হয় সে দরজার পাশ থেকে নড়বে। মেয়েটা মাঝে মাঝে এরকম করে কোনো কথাই শোনে না। চা বানিয়ে না আনলেই ভালো হয়। ফরহাদ উদ্দিনের চায়ের পিপাসা পায় নি। মেয়েটার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার জন্যে কথা বলা। মায়া পড়ে গেলে যা হয়। যার উপর মায়া পড়েছে তার সঙ্গে শুধু কথা বলতে ইচ্ছা করে। এই ইচ্ছাটিই বিপজ্জনক। কথা বলা মানেই মায়া বাড়ানো।
ফরহাদ উদ্দিন ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। এই নিঃশ্বাস কনক মেয়েটার জন্যে। মেয়েটা পড়ে গেছে আউলা ঝাউলার মধ্যে। বদরুলের মেয়ে আউলা ঝাউলার মধ্যে পড়বে এটা জানা কথা কিন্তু এতটা যে পড়বে তা ফরহাদ উদ্দিন নিজেও ভাবেন নি। কনকের বয়স যখন সাত বছর—বদরুল নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। সেই নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনাও অদ্ভুত। বদরুল একদিন হঠাৎ অফিস কামাই দিয়ে বাসায় এসে উপস্থিত। হাতে বিরাট সাইজের একটা ইলিশ মাছ। তার না-কি হঠাৎ সর্ষে বাটা দিয়ে ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছ করছে। ঘরে সর্ষে ছিল না। মাছ রেখে সে গেল সর্ষে কিনতে। এই যে গেল আর ফিরল না। তাকে খোজার চেষ্টা কম করা হয় নি। হাসপাতালে খোঁজ নেয়া হয়েছে! মর্গে খোঁজ নেয়া হয়েছে, আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামে খোঁজ নেয়া হয়েছে—কোনো লাভ হয় নি।