নাহার ভাবী সমস্তই জেনেছিলেন। বিয়ের সাত দিন না পেরুতেই তিনি আমাদের বাসায় এসে সবার সঙ্গে গল্প করলেন। রাবেয়াকে নিয়ে গেলেন তাঁদের বাসায়। রাবেয়া হাতে হলুদ রঙের একটা প্যাকেট নিয়ে হাসতে হাসতে বাসায় ফিরল।
মা দ্যাখো, ঐ মেয়েটি আমায় কী সুন্দর একটা শাড়ি দিয়েছে। আমি চাই নি, ও আপনি দিলে।
রাবেয়া নীল রঙের একটা শাড়ি আমাদের সামনে মেলে ধরল। চমৎকার রং। অদ্ভুত সুন্দর।
কাক ডাকল। ভোর হচ্ছে বুঝি। কোমল একটা আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াতেই আযান হল। মাঠের ওপারে ঝাঁকড়া কাঁঠালগাছের জমাট-বাঁধা অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। বাঁশের বেড়ার উপর হাত রেখে নাহার ভাবী খালি পায়ে ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। খুব সকালে ঘুম ভাঙে তাঁর। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন অল্প, বললেন, আজ দেখি খুব ভোরে উঠেছেন।
আমি চুপ করে রইলাম, হ্যাঁ-বাচক মাথা নড়লাম একটু।
নাহার ভাবী বললেন, রাতে আপনার গান বাজিয়েছিলাম, শুনেছেন?
জ্বি, শুনেছি।
রুনুর পছন্দ-করা গান। সেই সাজিয়ে দিয়েছিল। রুনু ঘুমুচ্ছে এখনো?
জ্বি।
ডেকে দিন একটু, খালি পায়ে বেড়াবে শিশিরের ওপর। চোখ ভালো থাকে।
রুনু রাবেয়ার গলা জড়িয়ে অকাতরে ঘুমুচ্ছে। আমি ডাকলাম রুনুরুনু।
মা
কদিন ধরেই দেখছি মা কেমন যেন বিমর্ষ। বড়ো ধরনের কোনো রোগ সারবার পর যেমন সমস্ত শরীরে ক্লান্তির ছায়া পড়ে, তেমনি। বয়স হয়েছে, ভাঙা চাকার সংসার টেনে নিতে অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন, দেহ মন শ্রান্ত তো হবেই। তবু তাঁর এমন অসহায় ভাবটা আমার ভালো লাগে না। খুব শিগগিরই হয়তো আমি একটি ভালো চাকরি পাব। আমি সবাইকে পরিপূর্ণ সুখী করতে চাই। মাকে নিয়ে একবার সীতাকুণ্ড বেড়াতে যাব। কলেজে যখন পড়ি, তখন কবন্ধুকে নিয়ে এক বার গিয়েছিলাম। এত সুন্দর, এত আশ্চর্য! চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে দূরে সমুদ্র দেখা যায়। মা নিশ্চয়ই চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উঠতে পারবেন না। মা আর বাবাকে নিচে রেখে আমরা সবাই উপরে উঠব। বাবাও হয়তো উঠতে চাইবেন। ঠিক সন্ধ্যার আগে-আগে উঠতে পারলে সূর্যস্ত দেখা যাবে! রেকর্ডপ্লেয়ার নেব, অনেক রেকর্ডও নিয়ে যাব।
খোকা, ও খোকা।
কি মা।
কিছু না, গল্প করি তোর সাথে, আয়!
বসেন, সারা দিন তো কাজ নিয়েই থাকেন।
কই আর কাজ?
আপনার স্বাস্থ্য খুব ভেঙে গেছে, মা।
আর স্বাস্থ্য!
মা বসলেন আমার সামনে। তাঁর চোখের কোণে গাঢ় কালি পড়েছে। তিনি থেমে থেমে বললেন, কাল রাতেও আমার ঘুম হয় নি, খোকা।
আমায় ডাকলেন না কেন, ওষুধ ছিল তো আমার কাছে।
দু বার ডেকেছি, তুই ঘুমুচ্ছিলি।
মা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। আমার খুব ঘুম বেড়েছে দেখছি। রাত নটা বাজতেই ঘুমিয়ে পড়ি, উঠি পরদিন আটটায়। মা বললেন, রাবেয়াকে নিয়ে তোর বড়ো খালার কাছে একবার যাব।
হঠাৎ কী ব্যাপার?
এমনি-ঘুরে আসি একটু।
কোনো পীরেব খোঁজ পেয়েছেন বুঝি?
মা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। আমি দেখলাম, মার নাকের পাতলা চামড়া তিরতির করে কাঁপছে। মাকে আমার হঠাৎ খুব ছেলেমানুষ মনে হল। বললাম, রাত-দিন কী এত ভাবেন?
কই, কিছু ভাবি না তো। চা খাবি এক কাপ?
এই দুপুরে।
খাঁ না। আগে তো খুব চা চাইতি।
মা উঠে চলে গেলেন। মার ভিতর একটা স্পষ্ট পরিবর্তন এসেছে। শরীর সুস্থ নয় নিশ্চয়ই। মাকে এক জন বড়ো ডাক্তার দেখালে হত। রুনুর স্কুল ছুটি হয় সাড়ে চারটায়। আজ সে দুপুরেই হাজির। হাসতে হাসতে বলল, স্কুল ছুটি হয়ে গেল দাদা।
সকাল সকাল যে! কি ব্যাপার?
মনিং স্কুল আজ থেকে। সকাল সাতটায় স্কুলে গেলাম। তুমি তো তখন ঘুমে। বাৰ্বাহ্, এত ঘুমুতেও পার।
মা চা নিয়ে ঢুকলেন। রুনু বলল, আমায় এক কাপ দাও না মা।
আরেকটা কাপ এনে ভাগ করে নে।
না, তা হলে থাক। দাদা খাক।
আহা, নে না।
রুনু চা নিয়ে বসল একপাশে। চুমুক দিতে কী ভেবে হাসল খনিকক্ষণ। বলল, মা খিদে পেয়েছে, কি রানা মা আজকে?
মাছ। খিদে নিয়ে চা খেতে আছে?
ওতে কিছ হবে না, মা। আচ্ছা, আপাকে দেখলাম বাবার সঙ্গে রিকসা করে যাচ্ছে। কোথায়?
কি জানি কোথায়। তোর আম-কাঁঠালের বন্ধ করে রুনু।
দেরি আছে, সামনের মাসের পনের তারিখ থেকে।
আমি তোর খালার বাসায় যাব বেড়াতে। তুই তাহলে থাকবি?
সে কি, তোমার সঙ্গে কে কে যাবে মা?
আমি, রাবেয়া আর তোর আব্বা।
বেশ তো! আমি বুঝি বাতিল?
রুনুর কথার ভঙ্গিতে হেসে ফেললাম। সবাই। রুনু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দাদা, তোমার চাকরি হলে আমায় নিয়ে বেড়াতে যাবে?
নিশ্চয়ই।
আমি কিন্তু কক্সবাজার যাব। শীলুরা গিয়েছিল গত বার।
বেশ তো।
আর যেদিন প্রথম বেতন পাবে সেদিন—
সেদিন কি রুনু?
সেদিন আমাকে দশ টাকা দিতে হবে। দেবে তো?
হ্যাঁ, কী করবি?
এখন বলব না।
রুনু লম্বা হয়েছে একটু, চোখের তারাও যেন মনে হয় আরো গভীর কালো। চাঞ্চল্যও এসেছে একটু। সেদিন দেখলাম অনেকক্ষণ ধরেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াল। সে কি বুঝতে পারছে তার চোখের পাতায়, তার হলুদ গালে, বরফিকাটা মসৃণ চিবুকে রূপের বন্যা নামছে। যৌবনের সেই লুকান চাবি দিয়ে প্রকৃতি একটি একটি করে অজানা ঘর খুলে দিচ্ছে তার সামনে। সে দেখছি প্রায় রাতেই শুয়ে শুয়ে উপন্যাস পড়ে। পড়তে পড়তে এক এক বার চোখে রুমাল দিয়ে কেঁদে ওঠে। আমি বলি, কী হয়েছে রুনু?
কই, কিছুই তো হয় নি।
কাঁদছিস কেন?
কাঁদছি, না তো।