- বইয়ের নামঃ নক্ষত্রের রাত
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী, রোম্যান্টিক গল্পের বই
একটি জার্মান ঘড়ি
দেয়ালে অদ্ভুত আকৃতির একটি জার্মান ঘড়ি। অন্ধকারে এর ডায়াল থেকে সবুজ আলো বের হয়। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেয়ালের দিকে তাকালে মনে হয় ট্রাফিক সিগন্যাল। খাটটাকে মনে হয় একটা গাড়ি। সবুজ আলো পেয়ে চলতে শুরু করবে।
আজও সে রকম হল। পাশার কয়েক সেকেণ্ড সময় লাগল নিজেকে ধাতস্থ করতে। ভূতুড়ে ঘড়িটা সরিয়ে ফেলা দরকার–এই রকম ভাবতে ভাবতে সে দ্বিতীয় বার তাকাল।
দুটো দশ বাজে।
এত রাতে হঠাৎ করে ঘুম ভাঙল কেন? ঘুম ভাঙার কোনোই কারণ নেই। সে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখে নি। কোথাও কোনো শব্দ হচ্ছে না। রান্নাঘর থেকে গ্যাস লিক করছে না। হিটিং ঠিকমত কাজ করছে। ঘরের ভেতর আরামদায়ক উষ্ণতা। ঘুম ভাঙার কোনোই কারণ নেই। কিন্তু এই পৃথিবীতে কার্যকারণ ছাড়া কিছুই হয় না। নিউটনের ক্ল্যাসিকাল মেকানিক্স তাই বলে। কাজেই কারণ কিছু একটা নিশ্চয়ই আছে। থাকতেই হবে।
পাশাবিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। বাথরুমে ঢুকে চোখে-মুখে পানি ছিটাল। ফ্ৰীজ থেকে ঠাণ্ডা পানির বোতল বের করল। সে এখন একটি সিগারেট ধবে এবং বরফ-শীতল এক গ্রাস পানি খাবে। হঠাৎ ঘুম ভাঙলে এই তার রুটিন।
পানিতে ওষুধ-ওষুধ গন্ধ। এরা কি ইদানীং বেশি করে ক্লোরিন দিচ্ছে? নাকি তার স্নায়ু নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করেছে?
যাদের স্নায়ু নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করে, তাদের এরকম হয়। সব কিছুতেই অদ্ভুত কোন গন্ধ পায়। শুরুর দিকে ফরিদের এ রকম হত। যা-ই মুখে দিত থু করে ফেলে দিয়ে বলত-লাশের গন্ধ আসছে। সবাই ভাবত, বোধহয় ঠাট্টা করছে। পাশা এক দিন দামী সেন্টের বোতল খুলে বলেছে, দেখ তো এর মধ্যে কোন অদ্ভুত গন্ধ পাস কি? ফরিদ বাধ্য ছেলের মতো গন্ধ শুকে ঠাণ্ডা গলায় বলেছে, পচা বট পাতার গন্ধ। খুব হালকা–তবে আছে।
পাশা বিরক্ত হয়ে বলল, তুই যা শুকছিল, তার নাম ইভিনিং ইন প্যারিস। ছাগলের মতো কথা বলছিস কেন? ফরিদ খুবই অবাক-হওয়া চোখে তাকিয়ে রইল।
কার্যকারণ ছাড়া কিছুই হয় না। কিন্তু ফরিদের সমস্ত ইন্দ্রিয় কোনো রকম কার্যকারণ ছাড়াই অত্যন্ত তীক্ষ্ণ হয়ে গিয়েছিল। ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্স সম্ভবত জড় পদার্থের জন্যে, মানুষের জন্যে নয়। মানুষের চেতনা বলে একটি ধরা-ছোঁয়ার বাইরের ব্যাপার আছে।
ওষুধের গন্ধভরা পানির গ্লাস শেষ হয়েছে। এখন শুয়ে পড়া যায়। পাশা ইচ্ছা করে একটা হাই তুলল–ঘুমকে আমন্ত্রণ জানাল। ঠিক তখন টেলিফোন বাজতে লাগল।
নিশিরাতে টেলিফোন কি অন্য রকম করে বাজে? ক্লান্ত সুর বের হয়? নাকি মনের ভুল? পাশা টেলিফোন তুলল। ও পাশে একটি আমেরিকান মেয়ে।
হ্যালো, আমি কার সঙ্গে কথা বলছি?
কার সঙ্গে কথা বলতে চাও তুমি?
পাশা।
কথা বলছি।
মেয়েটির গলায় সাউথের আঞ্চলিক টান আছে। এই দুর্বলতা নিয়েও সে ব্রিটিশ একসেন্ট আনবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক আসছে না।
মিঃ পাশা, আপনি কি বাংলাদেশী?
হ্যাঁ।
আপনি একজন মহিলার সঙ্গে কথা বলুন। মহিলা আপনার দেশীয়। মনে হচ্ছে তিনি বেশ ঝামেলায় পড়েছেন।
তুমি কোত্থেকে কথা বলছ?
হেক্টর এয়ারপোর্ট। ঐ মহিলা ঘন্টাখানেক আগে এয়ারপোর্টে এসে পৌছেছে। তাকে যাদের রিসিত করার কথা, তারা কেউ আসে নি। মেয়েটি খুব নাভাস হয়ে গেছে। খুব ছটফট করছে।
একটা ট্যাক্সি করে হোটলে পাঠিয়ে দাও।
আমি বলেছিলাম। মহিলাটি রাজি হচ্ছে না। কিছুক্ষণ আগেই দেখলাম কাঁদছে।
মেয়েটিকে দাও। কথা বলছি ওর সঙ্গে।
ও টয়লেটে গেছে। তোমাকে কিছুক্ষণ হোন্ড করতে হবে। পাশা টেলিফোন কানে নিয়েই সিগারেট ধরাল। তীক্ষ্ণ গলায় বলল, তুমি আমার টেলিফোন নাম্বার পেলে কোথায়?
আমেরিকান মেয়েটি আত্মতৃপ্তির হাসি হাসল। যেন এই প্রশ্নটির জন্যেই সে অপেক্ষা করছিল।
খুব কায়দা করে বের করেছি। টেলিফোন ডাইরেক্টরি বের করে মেয়েটিকে বলেছি-এখানে নিশ্চয়ই তোমাদের দেশের কেউ-না-কেউ বাস করে। তুমি নামগুলি পড় এবং অনুমান করতে চেষ্টা কর কোন কোন নাম তোমাদের দেশের হতে পারে।
সে শুধু আমার নামই বের করল?
সে অনেকগুলিই বের করেছে। তোমারটাই প্রথম ট্রাই করতে বলল। কারণ তোমার লাস্ট নেম নাকি শুধু তোমাদের দেশের ছেলেদের হয়। কাউড্রি। অদ্ভুত লাস্ট নোম।
কাউড্রি নয়। চৌধুরী। তোমার নাম কী?
এ্যান। আমি এখানেই কাজ করি। আমার ডিউটি অনেক আগেই শেষ হয়েছে। চলে যেতাম। মেয়েটির জন্যে যেতে পারছি না।
তোমাকে ধন্যবাদ। এখন তুমি চলে যেতে পারবে, আমি যা করণীয় করব।
থ্যাংস।
মেয়েটি কাঁদছিল বললে। ওর বয়স কত? খুব কম বয়স কি?
বুঝতে পারছি না। এশিয়ান মেয়েদের বয়স কেউ বুঝতে পারে না। ও এসে গেছে, তুমি কথা বল।
পাশা একটি কিশোরীর গলা শুনল। থেমে-থেমে ভয়ে-ভয়ে বলা–হ্যালো, হ্যালো।
আপনার ব্যাপারটা কী? কী হয়েছে?
আপনি দয়া করে একটু আসুন।
আসছি। সমস্যাটি কী? কোত্থেকে আসছেন আপনি?
ঢাকা থেকে।
সরাসরি তো ঢাকা থেকে আসেন নি। পোর্ট অব এন্ট্রি কোথায়? নিউ ইয়র্ক না। সিয়াটল?
নিউ ইয়র্ক। কেনেডি এয়ারপোর্ট। আপনি দয়া করে আসুন।
আপনার সঙ্গে কি শীতের কাপড় আছে? প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাইরে।
গরম সোয়েটার আছে। মাফলার আছে। একটা ওভারকোট ছিল।