- বইয়ের নামঃ নন্দিত নরকে
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ খান ব্রাদার্স এ্যাণ্ড কোং
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
রাবেয়া
রাবেয়া ঘুরে ঘুরে সেই কথা কটিই বার বার বলছিল।
রুনুর মাথা নিচু হতে হতে থুতনি বুকের সঙ্গে লেগে গিয়েছিল। আমি দেখলাম তার ফর্স কান লাল হয়ে উঠেছে। সে তার জ্যামিতি-খাতায় আঁকিবুকি কাটতে লাগল। শেষ পর্যন্ত হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে দাদা একটু পানি খেয়ে আসি বলে ছুটতে ছুটিতে বেরিয়ে গেল। রুনু বারো পেরিয়ে তেরোতে পড়েছে। রাবেয়ার অশ্লীল কদৰ্য কথা তার না বোঝার কিছু নেই। লজ্জায় সে লাল হয়ে উঠেছিল। হয়তো সে কেঁদেই ফেলত। রুনু অল্পতেই কাঁদে। আমি রাবেয়াকে বললাম, ছিঃ রাবেয়া, এসব বলতে আছে? ছিঃ! এগুলি বড় বাজে কথা। তুই কর্তা বড় হয়েছিস।
রাবেয়া আমার এক বৎসরের বড়ো। আমি তাকে তুই বলি। পিঠা পিঠি ভাইবোনেরা এক জন আরেক জনকে তুই বলেই ডাকে। রাবেয়া আমাকে তুই বলে। আমার প্রতি তার ব্যবহার ছোটবোনসুলভ। সে আমার কথা মন দিয়ে শুনল। কিছুক্ষণ ধরেই বালিশের গায়ে চাদর জড়িয়ে সে একটা পুতুল তৈরি করছিল। আমার কথায় তার ভাবান্তর হল না। পুতুল তৈরি বন্ধ রেখে লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। পা নাচাতে নাচাতে সে নোংরা কথাগুলি আগের চেয়েও উঁচু গলায় বলল। আমি চুপ করে রইলাম। বাধা পেলেই রাবেয়ার রাগ বাড়বে; গলার স্বর উঁচু পর্দায় উঠতে থাকবে। পাশের বাসার জানালা দিয়ে দু-একটি কৌতূহলী চোখ কী হচ্ছে দেখতে চেষ্টা করবে।
রাবেয়া বলল, আমি আবার বলব।
বেশ।
কী হয় বললে?
আমি কাতর গলায় বললাম, সে ভারি লজ্জা রাবেয়া। এটা খুব একটা লজ্জার কথা।
তবে যে ও আমাকে বলল।
কে?
আমি বুঝতে পারছি, রাবেয়া নিশ্চয়ই কথাগুলি বাইরে কোথাও শুনে এসেছে। কিন্তু রাবেয়াকে, যার বয়স গত আগষ্ট মাসে বাইশ হয়েছে, তাকে সরাসরি এমন একটি কদৰ্য্য কথা কেউ বলতে পারে ভাবি নি।
আমি বললাম, কে বলেছে?
আজ সকালে বলেছে।
কে সে?
ঐ যে লম্বা ফর্সা।
রাবেয়া সেই ছেলেটির আর কোনো পরিচয়ই দিতে পারবে না। আবারও রাবেয়াবেড়াতে বেরুবে, আবার হয়তো কেউ এমনি একটি ইতর অশ্লীল কথা বলে বসবে তাকে।
খোকা তোর দুধ।
মা দুধের বাটি টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। কাল রাতে তাঁর জ্বর এসেছিল। বেশ বাড়াবাড়ি রকমের জ্বর। বাবা মাঝরাত্তিরে আমার দরজায় ঘা দিয়েছিলেন। আমার ঘুমের ঘোর না কাটতেই শুনলাম, তোর কাছে এ্যাসপিরিন আছে খোকা?
স্বপ্ন দেখছি এই ভেবে পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়ার উদ্যোগ করতেই মায়ের কান্না শুনলাম। মা অসুখ-বিসুখ একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। অল্প জ্বর, মাথা ব্যাথা–এতেই কাহিল।
বাবা আবার ডাকলেন, খোকা, তোর কাছে এ্যাসপিরিন আছে?
তোষকের নিচে আমার ডাক্তারখানা। এ্যাসপিরিন, ডেসপ্রোটেব এই জাতীয় ট্যাবলেট জমান আছে। অন্ধকারেই আমি মাঝারি সাইজের ট্যাবলেট খুঁজতে লাগলাম। এ ঘরে আলো নেই। কোথায় যেন তার জ্বলে গেছে। রাতে হ্যাঁরিকেন জ্বালান হয়। ঘুমুবার সময় রুনু হারিকেন নিবিয়ে দেয় আলোতে রুনুর ঘুম হয় না। বাবা বললেন, খোকা, পেয়েছিস?
হুঁ। কী হয়েছে?
তোর মার জ্বর।
জ্বরে এ্যাসপিরিন কী হবে?
খুব মাথাব্যথাও আছে।
অ।
তিনটি ট্যাবলেট হাতে নিয়ে দরজা খুলতেই বারান্দায় লাগান পঁচিশ পাওয়ারের বাল্ব্বের আলো এসে পড়ল। কী বাজে ব্যাপার! একটিও এ্যাসপিরিন নয়। বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, ঘরে দেশলাই রাখতে পারিস না?
মনে পড়ল ড্রয়ারে একটি নতুন দেশলাই আর তিনটি বৃস্টল সিগারেট রয়েছে। সারা দিনে পাঁচটার বেশি খাব না ভেবেও সাতটা হয়ে গেছে। আর এখন এই মধ্যরাতে একটা তো জ্বালাতেই হবে। কিছুক্ষণের ভেতরই একটু সিগারেট ধরাব, এতেই মনটা ভরে উঠল। বাবা এ্যাসপিরিন নিয়ে চলে গেলেন। দেশলাই জ্বালাতেই চোখে পড়ল, রাবেয়া বিশ্ৰীভাবে শুয়ে রয়েছে। প্রায় সমস্তটা শাড়ি পাকিয়ে পুটলি বানিয়ে বুকের কাছে জড়িয়ে রেখেছে। শীতের সময় মশা থাকে না, মশারির আবুও সেই কারণেই অনুপস্থিত। বাবোব গলা শোনা গেল, নাও শানু, খেয়ে ফেল ট্যাবলেটটা।
আশ্চর্য! বাবা এমন আদুরে গলায় ডাকতে পারেন! আমার লজ্জা করতে লাগল। বাবা আবার ডাকলেন, শানু শানু।
শাহানা নামটাকে কী সুন্দর করে ভেঙে শানু ডাকছেন বাবা। আমার আর বাবার ঘরের ব্যবধানটা বাঁশের বেড়ার ব্যবধান। উপরের দিকে প্রায় দু হাত খানিক ফাঁকা। সামান্যতম শব্দের কথাও আমার ঘকে ভেসে আসে। আমি একটা চুমুর শব্দও শুনলাম।
আমার মাঝে মাঝে ইনসমনিয়া হয়। আমার তোষকের নিচে চারটে ভেলিয়াম-টু ট্যাবলেট আছে। কিন্তু আমি কখনো ভেলিয়াম খাই না। ঘুমের ওষুধ হার্ট দুর্বল করে। আমার বন্ধু সলিল ঘুমোনর জন্য দুটি মাত্র বড়ি খেয়ে মারা গিয়েছিল। তার হার্টের অসুখ ছিল। আমারও হয়তো আছে। আমার মাঝে মাঝে বুকের বাম পাশে চিনচিনে ব্যথা হয়।
আমি হাজার ইনসমনিয়াতেও ঘুমের ওষুধ খাই না। মাঝে মাঝে এ জন্যে আমার বেশ অসুবিধা হয়। মাঝরাতে বাবা যখন শানু শানু, এই শাহানা বলে ডাকতে থাকেন, তখন আমার কান গরম হয়ে ওঠে। নাক ঘামতে থাকে। হার্টের স্পন্দন দ্রুত ও স্পষ্ট হয়। রাতের নাটকের সব কটি কথা আমার জানা। মা বলেন, আহা করি কি? ছি! বাবা ফিসফিস করে কী বলেন। তাঁর গলা খাদে নেমে আসে। মা জড়িত কণ্ঠে হাসেন। আমি দু হাতে আমার কান বন্ধ করে ফেলি। নিজের বুকের শব্দটা সে সময় বড়ো বেশি স্পষ্ট মনে হয়। কিছুক্ষণের ভিতরই আবার সব নীরব হয়।