তার চোখের কোণে চব্বিশ ঘণ্টাতেই কালি পড়েছে। আমি বললাম, পাওয়া যাবে রুনু, ভয় কি?
কিন্তু ও যে ঠিকানা জানে না। কেউ যদি ওকে খুঁজে পায়, ও কি কিছু বলতে পারবে?
সে কিছুই বলতে পারবে না। তার বড়ো বড়ো চোখে সে হয়তো অসহায়ের মতো তাকাবে। মেলায় হারিয়ে যাওয়া ছোট খুঁকির মতো শুধুই বলবে, আমি বাড়ি যাব। আমি বাড়ি যাব। সে বাড়ি যে কোথায়, তা তার জানা নেই।
রুনু আবার বলল, দাদা, ও যদি কোনো বাজে লোকের হাতে পড়ে?
রুনু বুঝতে শিখেছে। মেয়েদের মানসিক প্রস্তুতি শুরু হয় ছেলেদেরও আগে। তারা তাদের কচি চোখেও পৃথিবীর নোংরামি দেখতে পায়। সে নোংরামির বড়ো শিকার তারাই। তাই প্রকৃতি তাদের কাছে অন্ধকারের খবর পাঠায় অনেক আগেই।
রাবেয়া ফিরে এল রাত আটটায়। সঙ্গে মাস্টার কাকা। বুকের উপর চেপে-বসা দুশ্চিন্তা নিমিষেই দূর হল। মাস্টার কাকা বললেন, ওকে আমি স্কুলের কাছে পাই, হারিয়ে গেছে তা আমি জানতাম না। এসব শোনার উৎসাহ আমার ছিল না। পাওয়া গেছে এই যথেষ্ট। স্কুলঘরের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল, মাস্টার কাকাকে দেখে দৌড়ে রাস্তা পার হল, আরেকটু হলেই গাড়িাচাপা পড়ত। এ সবে এখন আর আমাদের উৎসাহ নেই। বাবা পরপর দু দিন রোজা রাখলেন।
খোকা, ও খোকা।
কি?
বাতি জ্বাল।
কেন?
আমার বাথরুম পেয়েছে।
বারেয়া মশারির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। আমি বললাম, বাতি জ্বালাতে হবে না। আয়, বারান্দায় আলো আছে।
না, জ্বাল।
দেশলাই খুঁজে হ্যাঁরিকেন জ্বালালাম। দরজা খুলতেই ওঘর থেকে মা বললেন, কে? শেষরাতের দিকে মায়ের ঘুম পাতলা হয়ে আসে।
আমরা মা, রাবেয়া বাথরুমে যাবে।
বারান্দায় এসে রাবেয়া হাই তুলল। বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, কি চনমনে গন্ধ ফুলের, না?
হুঁ। ফুলের গন্ধ তোর ভালো লাগে, রাবেয়া?
না, বাজে।
বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বলল, পলা কবে আসবে, খোকা?
পলার সঙ্গে তার কোথায় যেন একটা যোগসূত্র আছে। মাঝে মাঝেই পলার কথা জানতে চায়। কে জানে কুকুরটা যে কিসের দুঃখে বিবাগী হল।
আজ রাতেও এক ফোঁটা ঘুম হবে না। দু মাস পরেই পরীক্ষা, এক রাত্রি ঘুম না-হলে পরপর দু দিন পড়া হয় না। বুঝতে পারছি কোন ফাঁকে মশা ঢুকেছে। কয়েকটা। কেবল গুনগুন করছে। কানের কাছে। কান অথবা মুখের নরম মাংস থেকে এক ঢোক করে রক্ত না-খাওয়া পর্যন্ত এ চলতেই থাকবে। পাখা করে মশা তাড়াবার ইচ্ছে হচ্ছে না। বালিশে মাথা গুঁজে ঘুমের জন্যে প্ৰাণপণে আমার সমস্ত ভাবনা মুছে ফেলতে চাইলাম।
হঠাৎ করেই অনেকটা আলো এসে পড়ল ঘরে। শীলুদের বারান্দার এক শ ওয়াটের বাঘাটা জ্বলিয়েছে। কেউ। কে হতে পারে? শীলুর বাবা না। নাহার ভাবী? শীলু কিংবা তার মাও হতে পারে। শীলুর মা চমৎকার মহিলা। এক বার এসেছিলেন আমাদের ঘরে।
শীলুর মা, যিনি সন্ধ্যায় লিনে বসে শীলুর বাবার সঙ্গে হেসে হেসে চা খান, বিকেলে প্রায়ই হারুন ভাই-এর পার্টনার হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ব্যাডমিন্টন খেলেন, যাঁর একটি গাঢ় সবুজ শাড়ি আছে, যেটি পরলে তাঁর বয়স দশ বৎসর কম মনে হয়, তিনি এক দিন এসেছিলেন আমাদের বাসায়। সেদিন ছিল শুক্রবার। রুনুর স্কুল বন্ধ ছিল, বাবা ছিলেন অফিসে। শীলুর মা লাল বুটি দেওয়া হালকা নীল শাড়ি পরেছিলেন। সোনালি ফ্রেমের চশমায় তাঁকে কলেজের মেয়ে-প্রফেসরের মতো দেখাচ্ছিল। আমার মা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, কী করে যত্ন করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন। না। আর শীলুর মা? তিনি মূর্তির মতো অনেকক্ষণ বসে থেকে একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন। আমরা অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম তাঁর দিকে। তিনি থেমে থেমে প্রতিটি শব্দে জোর দিয়ে বলেছিলেন, হারুনের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আপনার মেয়ে রাবেয়াকে বিয়ে করতে চায়।
আমরা সবাই চুপ করে রইলন। তিনি বলে চললেন, আপনার মেয়েকে পাঠাবেন না ওখানে। কি করে সে ছেলের মন ভুলিয়েছে! মাথার ঠিক নেই একটা মেয়ে। ছি! মা লজ্জায় কুকড়ে গেলেন।
রাবেয়া অকারণে মার খেল সেদিন। সব শুনে বাবার মেজাজ চড়ে গিয়েছিল। কেন সে যাবে হ্যাংলার মতো? রাগিলে বাবার মাথার ঠিক থাকে না। বয়ঙ্কা আধপাগলা একটা মেয়েকে তিনি উন্মাদের মতোই মারলেন। রাবেয়া শুধু বলছিল, আমি আর করব না। মারছ কেন? বললাম তো আর করব না।
কী জন্যে মরা খাচ্ছিল তা সে নিশ্চয়ই বুঝছিল না। বারবার তাকাচ্ছিল আমাদের দিকে। মা নিঃশব্দে কাঁদছিলেন। আর আশ্চৰ্য, কান্না শুনে প্রথম বারের মতো হারুন ভাই এলেন আমাদের বাসায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিনি অল্প অল্প কাঁপিছিলেন। তাঁর চোখ লাল। তিনি থেমে থেমে বললেন, ওকে মারছেন কেন?
বাবা তাকালেন হারুন ভাই-এর দিকে। আমিও ভীষণ বিরক্ত হয়েছিলাম। হঠাৎ তাঁর আমাদের এখানে আসা আমাদের ঠাট্টা করার মতোই মনে হল। রাবেয়া বলল, দেখুন না, আমাকে মারছে শুধু শুধু।
হারুন ভাই-এর ফ্যাকাশে মুখে আমি স্পষ্ট গভীর বেদনার ছায়া দেখেছিলাম। তবু কঠিন গলায় বললাম, আপনি বাসায় যান। আপনি এসছেন কেন?
শীলুদের বাসার জানালায় শীলু আর তার মা ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
রাবেয়াকে কদিন চাবি দিয়ে বন্ধ করে রাখা হল। তার দরকার ছিল না, হারুন ভাই-এর বিয়ে হল নাহার ভাবীর সঙ্গে। তাঁর খালাতো বোন, হোম ইকনমিক্সে বি. এ. পড়তেন। হারুন ভাই জার্মানী চলে গেলেন কেমিকেল ইঞ্জিনীয়ারিং-এ ডিগ্ৰী নিতে। আগেই সব ঠিক হয়ে ছিল।