বাবার সঙ্গে বিশেষ কথা হত না তাঁর। বাবা নিজে কম কথার মানুষ, মাস্টার কাকাও নির্লিপ্ত প্রকৃতির।
মাস্টার কাকাকে বাইরে থেকে শান্ত প্রকৃতির মনে হলেও তাঁর ভেতরে একটা প্রচণ্ড অস্থিরতা ছিল। যখন স্কুলে পড়তাম, তখন তিনি এস্ট্রলজি নিয়ে খবু মেতেছেন। কাজকর্মেও তাঁর মানসিক অস্থিরতার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে। গভীর রাতে খড়ম পায়ে হেঁটে বেড়াতেন। খটখট শব্দ শুনে কত বার ঘুম ভেঙে গেছে, কত বার মাকে আঁকড়ে ধরেছি শুয়ে। মা বলেছেন, ভয় কি খোকা, ভয় কি? ও তোর মাস্টার কাকা।
বাবা তারি। গম্ভীর গলায় ডাকতেন, ও মাস্টার, মাস্টার, শরীফ মিয়া, ও শরীফ মিয়া।
খড়মের খটখটি শব্দটা থেমে যেত। মাস্টার কাকা বলতেন কি হয়েছে?
ছেলে ভয় পাচ্ছে, কী কর এত রাত্ৰে?
তারা দেখছিলাম। এত তারা আগে আর ওঠে নি। দেখবে?
পাগল! যাও, ঘুমাও গিয়ে।
যাই।
মাস্টার কাকা খড়ম পায়ে খটখট করে চলে যেতেন।
আমাদের সবার পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়েছে তাঁর কাছে। আমি তাঁর প্রথম ছাত্র, তারপর মন্টু। পড়াশোনায় মন নেই বলে রাবেয়ার তো পড়াই হল না। রুনু এখন পড়ে তাঁর কাছে। বাড়িতে তেমন কোনো আত্মীয়স্বজন নেই তাঁর। থাকলেও যাবার উৎসাহ পান না। অবসর সময় কাটে এস্ট্রলজির বই পড়ে। অঙ্কের মাস্টার হিসেবে এস্ট্রলজি হয়তো ভালোই বোঝেন। মাঝে মাঝে তাঁর কাছ থেকে বই এনে পড়ি আমি। বিশ্বাস হয়তো করি না। কিন্তু পড়তে ভালো লাগে। আমি জেনেছি মীন রাশিতে আমার জন্ম। মীন রাশির লোক দার্শনিক আর ভাগ্যবান হয়। তাদের জীবন চমৎকার অভিজ্ঞতার জীবন। প্রচুর সুখ, সম্পদ, বৈভব। বেশ লাগে ভাবতে। কাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঐ যে সপ্তর্ষিমণ্ডল দেখছি না? ওর ডান দিকের ছোট্ট তারাটি হল কেতু। বড়ো মারাত্মক গ্রহ। আমার জন্মলগ্নে কেতুর দশা চলছিল!
জানি না, হয়তো জন্মলগ্নে কেতুর দশা থাকলেই আজীবন নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হয়। গভীর রাতে অনিদ্ৰাতপ্ত চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাগ্যনিয়ন্তা গ্রহগুলি পরখ করতে হয়। কাকাকে আমার ভালো লাগে। তার ভিতরে প্রচণ্ড জানিবার আগ্রহটিকে আমি শ্রদ্ধা করি। সামান্য বেতনের সবটা দিয়ে এস্ট্রলজির বই কিনে আনেন। দেশবিদেশের কথা পড়েন। মাঝে মাঝে বেড়াতে যান অপরিচিত সব জায়গায়। কোথায় কোন জঙ্গলে পড়ে আছে ভাঙা মন্দির একটি, কোথায় বাদশা বাবরের আমলে তৈরী গেটের ধ্বংসাবশেষ। সামান্য স্কুলমাস্টারের পড়াশোনার গণ্ডি আর উৎসাহ এত বহুমুখী হতে পারে তা কল্পনাও করা যায় না। তিনি মানুষ হিসেবে তত মিশুক নন। নিজেকে আড়াল করার চেষ্টাটা বাড়াবাড়ি রকমের। কোনো দিন মায়ের সঙ্গে মুখ তুলে কথা বলতে দেখি নি। খালি গায়ে ঘরোয়াভাবে ঘরে বসে রয়েছেন, এমনও নজরে আসে নি।
স্কুলে কাকা আমাদের ইতিহাস আর পাটীগণিত পড়াতেন। ইতিহাস আমার একটুও ভালো লাগত না। নিজের নাম হুঁমায়ুন বলেই বাদশা হুঁমায়ুনের প্রতি আমার বাড়াবাড়ি রকমের দরদ ছিল! অথচ আমাদের ইতিহাস বইয়ে ফলাও করেচ শেরশাহের সঙ্গে তাঁর পরাজয়ের কথা লেখা। শেরশাহ আবার এমনি লোক, যে গ্র্যাণ্ডটাঙ্ক রোড করিয়েছে, ঘোড়ার পিঠে ডাক চালু করিয়েছে। কিন্তু এত করেও ক্লাস সেতেনের একটি বাচ্চা ছেলের মন জয় করতে পারে নি। পরীক্ষার খাতায় তাঁর জীবনী লিখতে গিয়ে আমার বড়ো রকমের গ্লানি বোধ হত। সেই থেকেই সমস্ত ইতিহাঁসের ওপরই আমি বিরক্ত হয়ে উঠেছিলাম। কাকা তা জানতেন। এক দিন আমায় বললেন, খোকা তোর প্রিয় বাদশা হুমায়ূনের কথা বলব তোকে, বিকেলে ঘরে আসিস।
সেই দিনটি আমার খুব মনে আছে। কাকা আধশোয়া হয়ে তাঁর বিছানায়, আমি পাশে বসে, রুনু আর মন্টু সেই ঘরে বসে-বসে লুড়ু খেলছে। কাকা বলে চলেছেন, হুঁমায়ুন সম্পর্কে কে এক জন ছোট্ট একটি বই লিখেছিলেন-হুমায়ূন নামা। বইটিতে হুঁমায়ুনকে তিনি বলেছেন দুভাগ্যের অসহায় বাদশা। কিন্তু এমন দুভাগ্যবান বাদশা হতে পারলে আমি বিশ্ববিজয়ী সিজার কিংবা মহাযোদ্ধা নেপোলিয়ানও হতে চাই না। যুদ্ধ বন্ধ রেখে চিতোরের রাণীর ডাকে তাঁর চিতোর অভিমুখে যাত্রা, ভিত্তিওয়ালাকে সিংহাসনে বসোনর পিছনে কৃতজ্ঞতার অপরূপ প্রকাশ। গান, বই আর ধর্মের প্রতি কি আকর্ষণ! আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম। যেখানে আজান শুনে হুমায়ূন লাইব্রেরি থেকে দ্রুত নেমে আসছেন নামাজে সামিল হতে, নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে মারা গেছেন, সে-জায়গায় আমার চোখ ছলছল করে উঠল। কাকা বললেন, বড়ো হৃদয়বান বাদশা, সত্যিকার কবি হৃদয় তাঁর। আমার মনে হল আমিই যেন সেই বাদশা। আর আমাকে বাদশা বানানর কৃতিত্বটা কাকার একার।
আজ এই আশ্বিনের মধ্যরাত্রি, কাকা বসে আছেন ঠাণ্ডা মেঝেতে। অল্প অল্প শীতের বাতাস বইছে। জোছনা ফিকে হয়ে এসেছে। এখনি হয়তো চাঁদ ড়ুবে চারদিক অন্ধকার হবে। আমার সেই পুরনো কথা মনে পড়ল। আমি ডাকলাম, কাকা, কাকা।
কি।
অনেক রাত হয়েছে, ঘুমুতে যান।
যাই।
কাকা মন্থর পায়ে চলে গেলেন। আমি এসে শুয়ে পড়লাম। রাবেয়া ঘুমের মধ্যেই চেঁচাল, আম্মি আম্মি।
আমার মনে পড়ল রাবেয়া এক দিন হারিয়ে গিয়েছিল। চৈত্র মাস। দারুণ গরম। কলেজ থেকে এসে শুনি রাবেয়া নেই। তার যাবার জায়গা সীমিত। অল্প কয়েকটি ঘরবাড়িতে ঘুরে বেড়ায় সে। দুপুরের খাবারের আগে আসে; খেয়েদেয়ে অল্প কিছুক্ষণের ঘুম। তারপর আবার বেরিয়ে পড়া। সেদিন সন্ধ্যা উৎরেছে, রাবেয়া আসে নি। মার কান্না প্ৰায় বিলাপে পৌচেছে। মন্টু দুপুর থেকেই খুজছে। বাবা হতবুদ্ধি। একটি অপ্রকৃতিস্থ সুন্দরী যুবতী মেয়ের হারিয়ে যাওয়াটা অনেক কারণে বেদনাদায়ক। আমি কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাকে কি আবার ফিরে পাওয়া যাবে? রুনু চুপচাপ শুয়ে আছে তার বিছানায়। তার দুঃখপ্রকাশের ভঙ্গিটা বড়ো নীরব। এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা রুনুর ছোট শরীরটা একটা অসহায়তারই প্রতীক। আমায় দেখে রুনু উঠে বসল। বলল, কি হবে দাদা?