আমার প্রথমেই যা মনে হল, তা হল রাবেয়া না-বলেই এনেছে। কিন্তু রাবেয়া পোনি ঘোড়ার মতো ঘাড় বাঁকিয়ে বলতে লাগল, আমি আনি নি, ওরা আপনি দিয়েছে।
মিথ্যা রাবেয়া বলে না। কিন্তু ওরাই—বা কেন দেবে? এমন একটা সৌখিন জিনিস হঠাৎ করে দিতে হলে যে দীর্ঘ পরিচয় প্রয়োজন, তা কি আমাদের আছে? খবরের কাগজে কলমদানটি মুড়ে রুনু প্রথম বারের মতো ও-বাড়ি গেল। রাবেয়া নাকী সুরে বলতে লাগল, আমার জিনিস রুনু যে বড়ো নিয়ে চলল, ভেঙে ফেললে আমি মজা না–দেখিয়ে ছাড়ব?
জল্পনা গেল রাবেয়া আনে নি, ওরাই দিয়েছে। না, ঠিক ওরা নয়, হারুন বলে যে-ছেলেছি। শিগগিরই বিদেশে যাবে, শুধু একটি পাসপোর্টের অপেক্ষা-সে দিয়েছে। শীলু আর তার মাও ঠিক জানতেন না ব্যাপারটা। তাঁরাও একটু অবাক হয়েছেন। শীলুর সঙ্গে এই অল্প সময়েই খুব ভাব হয়ে গেল। রুনুর। একটি লম্বাটে মিমি চকলেট আর বিভূতিভূষণেব দৃষ্টিপ্রদীপ সে নিয়ে এসেছে। আমি বললাম, ওরা কেমন লোক রুনু?
খুব ভালো।
চকলেট পেয়ে গলে গেছিস, না?
যাও। শীলু। কিন্তু সত্যি ভালো। জান, শীলু মোটর চালাতে পারে।
যাহা এতটুকু বাচ্চা মেয়ে!
সত্যি। ওদের মোটর সারাতে দিয়েছে। যখন আসবে, তখন সে দেখাবে চালিয়ে।
আর কি গল্প হল?
কত গল্প, ওদের অনেক রেকর্ড আছে।
অনেক?
হুঁ, হিসেব নেই। এত। আমাকে রোজ যেতে বলেছে।
শুধু তুই যাবি, ও আসবে না?
আসবে না কেন? নিশ্চয়ই আসবে।
শীলু অবশ্যি এসেছে কালে-ভদ্রে। যখন তার রুনুর সঙ্গে দরকার পড়ত তখনি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ডাকত, রুনুরুনু। রুনু সব কাজ ফেলে ছুটে যেত। আমি মনে মনে চাইতাম, মেয়েটা ঘন ঘন আসুক আমাদের কাছে। তার সাথে গল্প করার ইচ্ছে হত আমার। আমি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম, তার সঙ্গে যদি আলাপ হয় তবে কী বলব। দু রাতে তাকে স্বপ্নেও দেখেছি।
একটি স্বপ্নে সে শাড়ি পরে এসে খুব পরিচিত ভঙ্গিতে বসেছে আমার টেবিলে। আমি বললাম, টেবিলে কেন শীলু, চেয়ারে বস।
শীলু হাসতে হাসতে বলল, টেবিলে বসতেই যে আমার ভালো লাগে। হাতে একটা চামচ নিয়ে টুং টাং করে চায়ের কাঁপে জলতরঙ্গের মতো একটা বাজনা বাজাতে লাগল সে।
দ্বিতীয় স্বপুটি দেখেছি দিনে-দুপুরে। অনুরোধের আসর শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ দেখলাম শীলু এল। আগের মতোই শাড়ি-পরা। আমি বলছি, শীলু, এত দেরি কেন, কী চমৎকার গান হচ্ছিল।
আমার নাম তো শীলা, আপনি শীলু ডাকেন কেন?
শীলুর সঙ্গে আমার কথা হত এই ধরনের। হয়তো বিকেলে বারান্দায় বসে আছি। হঠাৎ শীলু, ডাকল, শুনুন, একটু রুনুকে ডেকে দেবেন?
বাবা পেঙ্গুইন পাখির কলমদান দেখে খুব রাগ করলেন। বাবার পয়সা ছিল না। বলেই হয়তো অহংকার ছিল। শীলুদের পরিবারকে তাঁর একটুও পছন্দ হত না। নিজে আজীবন কষ্ট পেয়েছেন, অন্যের সুখ সে-কারণে সহজভাবে নেওয়ার মানসিকতা তাঁর ছিল না। প্রথম জীবনে ছিলেন স্কুলমাস্টার। প্রাইভেট স্কুল। মাইনের ঠিক ছিল না। আমরা সব তাঁর মাইনের উপর নির্ভর করে আছি দেখে মাস্টারি ছেড়ে ঢুকলেন ফার্মে। বারো বছরে ক্যাশিয়ার থেকে একাউন্টেন্ট হলেন। মাইনে সাড়ে তিনশ। কলমদানটা ফিরিয়ে দেবার জন্য বাবা পীড়াপীড়ি করছিলেন। কিন্তু রুনু বা মা কেউ সে নিয়ে এগালো না। কলমদানের পেঙ্গুইন পাখিটি ধ্যানী মূর্তির মতো বসে রইল আমার টেবিলে। রাবেয়া শুধু মাঝে মাঝে আমায় বলে, তোমার টেবিলে বলে এটা তোমার মনে কর না, খোকা। আচ্ছা, ইচ্ছে হলে মাঝে মাঝে কলম রেখা।
ঘুমের ঘোরে রুনু বলল, না, পানি খাব না। তারপর আরো খানিকক্ষণ উঁহু উঁহু করল। থানার ঘড়িতে ঢং করে শব্দ হল একটা। সাড়ে-বারো, এক, কিংবা দেড়–যে কোনোটা হতে পারে। আমার আরেকটা সিগারেট ধরাবার ইচ্ছে হচ্ছে। কে যেন বলেছিল সিগারেটের আনন্দটা আসলে সাইকলজিকেল। তুমি একটা কিছু পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছ, তার আনন্দ। অনেকে আবার বলেন, নিঃসঙ্গের সঙ্গী। এই মধ্যরাতে আমি একলা জেগে আছি, নিঃসঙ্গ তো বটেই। সিগারেটের একটি বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম সিনেমায়। সমস্ত পর্দা অন্ধকার। আবছা আলোয় হলে দেখা গেল বড়ো রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে কে এক জন। চারপাশে কেউ নেই, ভূতুড়ে আবহাওয়া, থমথম করছে। অন্ধকার। পর্দায় লেখা হল; সে কি নিঃসঙ্গ? লোকটি থমকে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল। পর্দায় লেখা হল ৪ না, নিঃসঙ্গ নয়। এই তো তার সঙ্গী। চমৎকার বিজ্ঞাপন। আমার মনে হয়, সিগারেটের নেশার মূল্যের চেয়ে বন্ধুত্বের মূল্য অনেক বেশি।
খুট করে দরজা খোলার শব্দ হল। আমি কান পেতে রইলাম। কে হতে পারে? বাবা নিশ্চয়ই নন, তিনি ওঠেন সাড়াশব্দ করে, দরজা খোলেন ধুমধাম শব্দ করে। মন্টু অথবা মাস্টার কাকা হবেন। টিউবওয়েলে পানি তোলার শব্দ হল অনেকক্ষণ। ছড়ছড়া করে পানি পড়ার আওয়াজ। কুলি করে পানি ছিটাতে ছিটাতে এদিকেই যেন আসছে। হ্যাঁ, মাস্টার কাকাই। তাঁর মাঝে মাঝে অনেক রাতে ফুলগাছের কাছে চেয়ার পেতে গুনগুন করে গান গাওয়ার শখ আছে। পলা বেঁচে থাকলে প্রথমটায় অপরিচিত জন ভেবে ঘেউঘেউ করত। তারপর গরগর করে পরিচিত জনের অভ্যর্থনা। মাস্টার কাকা বলতেন, কিরে পলু, তোরও বুঝি ঘুম নেই?
আমি কি ললাম, কে?
মাস্টার কাকা বললেন, আমি, খোকা।
কি করেন?
এই বসেছি একটু। যা গরম! তুই ঘুমুস নি এখনো?
জ্বি না।
আসবি নাকি বাইরে?