আমি বুঝি জানি?
যা জিনিস তা-ই বল। বল না।
উঁহু, তুমি বল দাদা।
রুনুকে আমার টমাস হার্ডির এ পেয়ার অব র আইজ-এর গল্প বলতে ইচ্ছে হয়। আমার মনে হয়। রুনুই যেন এ পেয়ার অব র আইজের নায়িকা। কিন্তু রুনু আমার ছোট বোন। সামনের নভেম্বরে সে চৌদ্দ বৎসরে পড়বে। এমন প্রেমের গল্প তাকে কি করে বলি। রুনু বলে, থেমে গেলে কেন দাদা? শেষ কর না।
আমি গল্প বন্ধ করে জিজ্ঞেস করি, রুনু, তোর কাকে সবচে ভাল লাগে?
তোমাকে।
হয়তো আমাকে তার সত্যি ভালো লাগে। বাইরে তীব্র জোছনা, ফুলের অপরূপ সৌরভ, মশারি উড়িয়ে নেবার মতো বাতাস। বুকের কাছটায় গভীর বেদনা অনুভব করি।
এই আপা, এই!
কী হয়েছে রুনু?
দাদা, আপা আমার গায়ে ঠ্যাং তুলে দিয়েছে।
রাবেয়া ঘুমের ঘোরে পা তুলে দিয়েছে রুনুর গায়ে। বেশ স্বাস্থ্য রাবেয়ার। স্বাস্থ্যুবতী মেয়েদের হয়তো ভরা যৌবনের মেয়ে বলে। ভরা যৌবনকথাটায় কেমন একটা অশ্লীলতার ছোঁয়া আছে। আমার কাছে যুবতী কথাটা তরুণীর চেয়ে অনেক অশ্লীল মনে হয়। কে জানে কেন!
পাশের বাসার লোকজনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। রাত যত বাড়ে আশেপাশের শব্দ। ততই স্পষ্ট হয়। দিনে কখনো থানার ঘড়ির ঘণ্টা শুনি না। রাত নটার পর থেকেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাশের বাসায় কে যেন কাশল। কিছুক্ষণ পর খিলখিল করে হাসির শব্দ শুনলাম। হাসির স্বরগ্রাম বেশ উঁচু। নিশ্চয়ই নাহার ভাবী। নাহার ভাবী উঁচু গলায় কথা বলেন। বিধি ডাগর আখি যদি দিয়েছিলো?–নাহার ভাবী রেকর্ড চড়িয়েছেন। প্ৰায় রােতই তিনি গান শোনেন। এই গানটি তাঁর ফেবারিটি। আমার রবীন্দ্রসংগীতের প্রাঙ্গণে মোর শিরিষশাখায় সব চেয়ে ভালো লাগে। এই রেকর্ডটি তাঁরা খুব কম বাজান। বিধি। ডঃ গর আখি বড়ো করুণ। নাহার ভাবী তো খুব হাসিখুশি। অথচ এমন একটি করুণ গান তাঁর পছন্দ কেন কে জানে। যারা খুব হাসি— খুশি, করুণ সুর তাদের খুব মুগ্ধ করে–কোথায় যেন পড়েছি।
রুনু হঠাৎ ডাকাল, দাঙ্গা ঘুমিয়েছ?
না।
নাহারা ভাবী গান বাজাচ্ছে।
হুঁ।
এর পর কোন গানটা বাজবে জান?
না, কোনটা?
আধুনিক। জোনাকি ঝিকিমিকি জ্বলো আলো।
সত্যি সত্যিই তাই বাজল। রুনু শব্দ করে হাসল।
আমি বললাম, তুই জানালি কী করে?
আমিই তো আজ দুপুরে সাজিয়ে রেখেছি। তোমার গান সবার শেষে।
রাবেয়া ঘুমের ঘোরে বলল, না না, বললাম তো যাব না। হারুন ভাই যদি সত্যি সত্যি রাবেয়াকে বিয়ে করে ফেলত, তবে আর মাঝরাতে গান শোনা হত না। রাবেয়ার গান ভালো লাগে না। কে জানে, কী তার ভালো লাগে। হারুন ভাইদের বাসার সবাই রাজি হলেও এ বিয়ে হত না।
রাবেয়া যদি কোনো দিন ভালো হয়ে ওঠে, তবে তাকে খুব এক জন হৃদয়বান ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেব। হারুন ভাইয়ের মতো একটি নিখুঁত ভালো ছেলে। সেও গভীর রাতে রেকর্ড বাজাবে। চাঁদের আলো এসে পড়বে তাদের দুজনার গায়। ভদ্রলোক রাবেয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলবেন, তোমার কপালে কিসের দাগ রাবেয়া?
পড়ে গিয়েছিলাম চৌকাঠে।
তিনি সেই কাটা দাগের উপর অনেকক্ষণ হাত রাখবেন। তারপর চুমু খাবেন সেখানটায়।
রুনু আমায় ডাকল, দাদা, তোমার গান হচ্ছে।
আমি শুনলাম প্রাঙ্গণে মোর শিরিষশাখায় ফাগুন মাসে কী উচ্ছ্বাসে। আবেগে আমার চোখ ভিজে উঠল। গানটি আমার বড়ো ভালো লাগে।
গ্ৰান শুনতে শুনতে আমি নাহার ভাবীর মুখ মনে আনতে চেষ্টা করলাম। মাঝে মাঝে খুব পরিচিত লোকদের মুখও আমি কিছুতেই মনে আনতে পারি না। নাহার ভাবীর মুখটা ত্ৰিভূজ আকৃতির। হারুন ভাইদের বাসার সবার মুখ আবার লম্বাটে, ডিমের মতো। তারা সবাই ভারি সুন্দর। কয় পুরুষ ধনী থাকলে চেহারায় একটা আলগা লালিত্য আসে কে জানে। ভাবতে ভালো লাগে, এই পরিবারটিতে কোনো দুঃখ নেই। মাসের পনের তারিখের পর থেকে খরচ বাঁচোনর আপ্রিাণ চেষ্টা এ পরিবারের মায়ের করতে হয় না। ইচ্ছে হলেই ইংরেজি ছবির মতো মোটরে করে। এরা আউটিং-এ চলে যায়। স্বাধীনতা-দিবসে এ পরিবারের মেয়েরারাইফেল শুটিংএ ফ্যাক্ট সেকেণ্ড হয়।
তারা কবে এসেছিল শান্তি কটেজে আমার মনে নেই, তবে খুব বৃষ্টি সেদিন। আমি, রাবেয়া আর বুনু বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। জীপ থেকে ভিজতে ভিজতে নামল সবাই। প্রথমে রুনুর বয়সী একটি মেয়ে। নাম শীলা। বাবা আদর করে ডাকেন শীলু মা, মা শুধু বলেন শীলু। তারপর বড় ভাই, চোখে বুড়ো মানুষের চশমা হলেও একেবারে ছেলেমানুষী চেহারা। গাড়ি থেকে নেমেই চেঁচিয়ে উঠল, কী চমৎকার বাড়ি শীলু। বাবা নামলেন, মা নামলেন, চাকর-বাকর নামল। আজিজ সাহেবদের চলে যাওয়ার অনেক দিন পর বাড়িটা তরল। বর্ষা গিয়ে শীত এল। ব্যাডমিন্টন কোর্ট কেটে হৈ হৈ করে দুই ভাইবোন লাভ ইলেভেন, লাভ টুয়েলাভ করে খেলতে লাগল।
রুণু বড়ো লাজুক, নয়তো সে গিয়ে তাদের সঙ্গে ভাব করতে পারত। আমার খুব ইচ্ছে হত শীলু। মেয়েটির সঙ্গে রুনুর ভাব হোক। আমি দেখতাম, সন্ধ্যা হলেই শীলু। তাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে কবুতর ওড়াত। তাদের দটি লোটন পায়রা ছিল। কারণ্যে-অকারণে যেত। রাবেয়া। তাকে আমরা বাধা দিতাম না। বাধা পেলেই রাবেয়ার মেজাজ বিগড়ে যেত। চিটাগাং-এ বড়ো খালার ভাসুর মস্ত ডাক্তার। তিনি বলেছিলেন, যা ইচ্ছে হয় তা-ই করতে দেবেন। একে। দেখবেন, যা এবনর্মালিটি আছে, তা আপনি সেরে যাবে। আমাদের চিকিৎসার টাকা ছিল না। নিখরচার চিকিৎসা তাই আমরা প্ৰাণপণে করতাম। এক দিন মা কাঁদো কাঁদো হয়ে আমার টেবিলে একটি কী যেন নামিয়ে রাখলেন। দেখি চমৎকার একটি কলমদানি। ধবধবে সাদা দুটি পেঙ্গুইন পাখি কলমদানের দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে। পেঙ্গুইন দুটোর মাঝামাঝি একটি বাচ্চা পেঙ্গুইন হাঁ করে শূন্যে তাকিয়ে। সেই হাঁ-করা মুখেই কলম রাখার জায়গা। আমার এ-জাতীয় জিনিসের দাম সম্বন্ধে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তবু মনে হল এ অনেক দামী। মা কাঁপা গলায় বললেন, রাবেয়া এনেছে। ওবাড়ি থেকে।