রুনু আর রাবেয়া ঘুমের ঘোরে বিজবিজ করে। টেবিল ঘড়ির টক টিক টক টক শব্দ আবার ফিরে আসে। আমি টেবিলে রাখা জগে মুখ লাগিয়ে ঢকঢ়ক করে পানি খেয়ে বাইরে এসে দাঁড়াই।
বারান্দার এক পাশে দুটি হাস্নুহেনা গাছ আছে। মা বলেন হাছনাহেনা। দুটোই প্রকাণ্ড। রাতের বেলায় তার পাশে এসে দাঁড়ালে ফুলের গন্ধে নেশার মতো হয়। হামুহেনার গন্ধে নাকি সাপ আসে। মন্টু এই গাছের নিচেই এক বার একটা মস্ত সাপ মেরেছিল। চন্দ্রবোড়া সাপ। মা দেখে আঁতকে উঠে বলেছিলেন, কি করলি রে মন্টু, এর জোড়াটা যে এবার তোকে খুঁজে বেড়াবে।
আমি যদিও এ-সব বিশ্বাস করতাম না, তবু আমার ভয় লাগছিল। আমি তন্ন তন্ন করে অন্য সাপটাকে খুঁজলাম। বাড়ির চারপাশে কার্বলিক এসিড দেওয়া হল। মাস্টার চাচা বললেন, যে সাপটা রয়ে গেছে সেটা পুরুষ সাপ। সাপ দেখে তিনি স্ত্রী-পুরুষ বলতে পারতেন। কদিন সবাই খুব ভয়ে ভয়ে কাটালাম, যদিও সেই পুরুষ সাপটিকে কখনো দেখা যায় নি।
রাবেয়া বলল, মা আমি দুধ খাব।
মার কাল রাতে জ্বর এসেছিল। তাঁর মুখ শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে। রাবেয়ার কথা শুনে মারি মুখ আরো শুকিয়ে গেল। তাঁকে বাচ্চা খুকির মতো দেখাতে লাগল। আমি জানি আমরা কেউ যখন কোনো একটা জিনিসের জন্যে আব্দার করি এবং মা যখন সেটি দিতে পারেন না। তখন তাঁর মুখ এমনি লম্বাটে হয়ে বাচ্চা খুকিদের মতো দেখাতে থাকে। তাঁর নাকের পাতলা চামড়া তিরতির করে কাঁপতে থাকে। ছোট বয়সে মার এই ভঙ্গিটাকে আঁমার খুব খারাপ লাগত। আমি একটি জিনিস চেয়েছি, মা সেটি দিতে পারছেন না। তাঁর মুখ বাচ্চা খুকিদের মতো হয়ে গিয়েছে। নাকের ফর্সা পাতলা পাতা তিরতির করে কীপছে। মায়ের এই ভঙ্গিটাকে আমার অপরাধীর ভঙ্গি বলে মনে হত। আমি মাকে কী করে কষ্ট দেওয়া যায় তা ভাবতে থাকতাম। মোর গায়ে একটি টিকটিকি ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে হত। মা টিকটিকিকে বড়ো ভয় পান। মুখে বলেন। ঘৃণা, কিন্তু আমি জানি এ তাঁর ভয়। এক বার মা ভাত খেতে বসেছেন, হঠাৎ ছাদ থেকে একটা টিকটিকির বাচ্চা এসে পড়ল তাঁর মাথায়। তিনি হড়হড় করে বমি করে ফেললেন। মার উপর রাগ হলেই আমি টিকটিকি খুঁজতাম। কিন্তু টিকটিকি খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল না। পেলেও ধরা যেত না। কাপড়ের বল বানিয়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারতাম দেয়ালে টিকটিকির গায়। টুপ করে তার ল্যাজ খসে পড়ত। সেই ল্যাজও মা ঘেন্না করতেন। মা কখনো আমাদের কিছু বলতেন না। মা বড়ো বেশি ভালোমানুষ। বাবা মারতেন প্রায়ই ভীষণ মার। মা বুলতেন, আহা কী করা! আহা ব্যথা পায় না? বাবা বলতেন, যাও, সরে যাও সামনে থেকে। আদর দিয়ে মাথায় তুলেছ তুমি। মাকে তখন বড়ো বেশি অসহায় মনে হত। আর আমার ইচ্ছে হত কাল ভোরেই বাড়ি থেকে পালাব। আর কখনো আসব না।
মা আমাকে দুধ দাও। রাবেয়া জোন করতে লাগল। আমি বাটিটি তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। মা মৃদু। কণ্ঠে বললেন, আহা, খা না তুই, তোর পরীক্ষা।
দুধের বিলাসিতাটুকু আমার জন্যেই। সামনেই এম.এস.সি ফাইনাল, রাত জেগে পড়ি। নটার দিকে মা দুধ নিয়ে আসেন। আমি দুধে চুমুক দিতেই মা নীরবে রাবেয়ার শাড়ি থেকে একটি একটি করে সেফটিপিন খুলতে থাকেন। রাবেয়ার শাড়িতে গোটা দশেক সেফটিপিন সারা দিন লাগান থাকে। সমস্ত দিন সে ঘুরে বেড়ায়। তার অনাবৃত শরীর ভুলেও যেন কারুর চোখে না পড়ে, এই ভয়েই মা এ করেন। রাবেয়াকে ঘরে আটকে রাখা যাবে না।–তাকে সালোয়ার কামিজও পরান যাবে না। তার সে-বয়স নেই। অথচ সবাই রাবেয়ার দিকে অসংকোচে তাকাবে। বয়স হলেই ছেলেরা মেয়েদের দিকে তাকায়। সেই তাকানীয় লজ্জা থাকে, দৃষ্টিতে সংকোচ থাকে। কিন্তু রাবেয়ার ব্যাপারে সংকোচ বা লজ্জার কোনো কারণ নেই। রাবেয়াকে যে-কেউ অতি কুৎসিত কথা বললেও সে হাসিমুখে সে-কথা শুনবে। বাড়ি এসে অনায়াসে সবাইকে বলে বেড়াবে।
মা রাবেয়ার পাশে বসে রাবেয়ার মাথায় হাত রাখলেন। আমি একটি ছোট কিন্তু স্পষ্ট দীর্ঘনিঃশ্বাসের শব্দ শুনলাম। রাবেয়া ঢকচক করে দুধ খাচ্ছে। রাবেয়া হয়তো ঠিক রূপসী নয়। কিংবা কে জানে হয়তো রূপসী। রং হালকা কালো। বড়ো বড়ো চোখ, স্বচ্ছ দৃষ্টি, সুন্দর ঠোঁট। হাসলেই চিবুক আর গালে টোল পড়ে। যেসমস্ত মেয়ে হাসলে টোল পড়ে, তারা কারণ্যে-অকারণে হাসে। তারা জানে হাসলে তাদের ভালো দেখায়। রাবেয়া তা জানে না, তবু সে হাসে। কারণে-অকারণে হাসে। রাবেয়ার কপালে, ঠিক মাঝখানে একটা কাটা দাগ আছে। ছোটবেলায় চৌকাঠে পড়ে গিয়েছিল। দুধ শেষ করে রাবেয়া বলল, বাজে দুধ। ছিঃ!
মা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, শুভাপুরের পীর সাহেবের কাছে যাবি এক বার? শুভাপুরে এক পীর সাহেব থাকেন। পাগল ভালো করতে পারেন বলে খ্যাতি। শুভাপুর এখান থেকে আট মাইল। সাইকেলে ঘণ্টাখানেক লাগে, কিন্তু আমি জানি পীর-ফকিরে কিছু হবে না। বড়ো ডাক্তার যদি কিছু করতে পারে। কিন্তু আমাদের পয়সা নেই। আমার ছোট হয়ে যাওয়া শার্ট মন্টু পরে। আমরা কাপড় কিনি বৎসরে এক বার, রোজার ঈদে।
রুনু এল একটু পরেই। আড়চোখে দু-তিন বার তাকাল রাবেয়ার দিকে। না, রাবেয়া সেই কুৎসিত কথাগুলি আর বলছে না। রুনু হাই তুলল। তার ঘুম পাচ্ছে। চোখ ফুলে উঠেছে। রাবেয়ার নোংরা কথা শুনে রুনুর কেমন লেগেছিল কে জানে। রুলুর বয়স এখন তেরো। আগামী নভেম্বরে চৌদ্দতে পড়বে। রুনুর বৃশ্চিক রাশি। আমার যখন এমন বয়স ছিল, তখন এ ধরনের কথা শুনে বেশ লাগত। সেই বয়সে মেয়েদের কথা ভাবতে আমার ভালো লাগত। টগর ভাইয়ের বাসায় সন্ধ্যাবেলা অঙ্ক বুঝতে যেতাম। নীলু বলে তার একটা ছোট বোন ছিল। বড়ো হয়ে এই মেয়েটিকে বিয়ে করব ভেবে বেশ আনন্দ হত আমার। নীলুর সঙ্গে কথা বলতেও লজ্জা লাগত, কথা বেধে যেত মুখে। নীলু। যখন আমার হাত ধরে টেনে বলত, আসুন না। দাদু ভাই, লুড়ু খেলি। তখন অকারণেই আমার কান লাল হয়ে উঠত। গলার কাছটায় ভার-তার লাগাত।