নাহার ভাবী মাথা নিচু করে বসে ছিলেন! আমার মনে হল, নাহার ভাবী আমাদের বড়ো আপন! বড়ো পরিচিত।
রাবেয়ার একটা ছবি দেবেন আমাকে?
ছবি?
জ্বি। আমি সঙ্গে নিয়ে যেতাম। ও খুশি হত দেখলে। রাবেয়াকে তার খুব ভালো লেগেছিল।
ওর তো কোনো ছবি নেই। আমাদের সবার শুধু একটা গ্রুপ ছবি আছে, মন্টুর জন্মের পর তোলা।
অ।
নাহার ভাবী চলে গেলেন। ট্রাঙ্ক খুলে ছবি বের করলাম আমি। পুরনো ছবি। হলুদ হয়ে গেছে। তবু কী জীবন্তই না মনে হচ্ছে! বাবেয়া হাসিমুখে বসে আছে মেঝেতে। রুনু বাবার কোলে। মন্টু চোখ বুজে বড়োমার কোলে শুয়ে। বুকে গভীর বেদনা অনুভব করছি। স্মৃতি-সে সুখেরই হোক, বেদনারই হোক–সব সময়ই করুণ।
সারা রাত ধরে বৃষ্টি হল। আষাঢ়ের আগমনী বৃষ্টি। বৃষ্টিতে সব যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। রুনু বলল, মনে আছে দাদা, এক রাতে এমনি বৃষ্টি হয়েছিল, তুমি একটা ভূতের গল্প বলেছিলে!
আমি কথা বললাম না। গলা পর্যন্ত চাদর টেনে হ্যাঁরিকেনের শিখার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বাবা হঠাৎ কবে বিকৃত গলায় ডাকলেন খোকা, ও খোকা!
কী বাবা?
আয়, তুই আমার কাছে আয়! মন্টুর জন্যে বুকটা বড়ো কাঁদে রে।
তিমিরময়ী দুঃখ। প্রগাঢ় বেদনার অন্ধকার আমাদের গ্রাস করছে। বাইরে গাছের পাতায় বাতাস লেগে হা হা হা হা শব্দ উঠল।
সতেরই আগষ্ট মন্টুর ফাঁসির হুকুম হল। মন্টু, যার জন্ম হয়েছিল মঘা নক্ষত্রযুক্ত সিংহ রাশিতে, রবির হোরায় বুধের দ্রেক্কাণে। কাকা বলেছিলেন, এ ছেলে হবে সাহসী, বুদ্ধিমান, জ্ঞানী ও প্রেমিক।
মন্টুর জীবন ভিক্ষা চেয়ে আমরা মার্সি-পিটিশন করলাম। আমার মনে পড়ল ফাঁসির হুকুম হওয়ার আগের দিনটিতে রোগা, শ্যামলা একটি মেয়ে আমাদের বাসায় এসেছিল। তার মুখটা নিতান্তই সাদাসিধে, ছেলেমানুষী চাহনি। মেয়েটি রিক্সা থেকে নেমেই থাতমত খেয়ে বাসার সামনে দাঁড়িয়েছিল। আমায় দেখে ঢোক গিলল।
বললাম, কার খোঁজ করছেন?
মেয়েটি মাথা নিচু করে কী ভাবছিল। হঠাৎ সাহস সঞ্চয় করে বলল, আমার নাম ইয়াসমিন। আমি আপনার ভাইয়ের সাথে পড়ি।
মন্টুর সঙ্গে?
জ্বি।
আস, ভেতরে আস। তুমি করে বললাম, কিছু মনে করো না।
মেয়েটি হেসে বলল, আমি কত ছোট আপনার, তুমি করেই তো বলবেন।
বাবা, মা আর রুনু মন্টুকে দেখতে গিয়েছেন। আমি মেয়েটিকে আমার ঘরে এনে বসালাম।
বস।
এখানে কে শোয়?
আমি আর রুনু।
রুনু কোথায়?
মন্টুকে দেখতে গিয়েছে। বাবা আর মা-ও গিয়েছেন।
আরও আগে আসলে আমিও রুনুর সঙ্গে যেতে পারতাম, না?
তুমি যেতে চাও?
জ্বি না। ওর খারাপ লাগবে।
মেয়েটি চুপ করে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে ঘর দেখতে লাগল।
আমি বললাম, চা খাবে?
জ্বি না।
কোথায় থাক তুমি?
উইখানে। মেয়েটি হয়তো বলতে চায় না। সে কোথায় থাকে। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়েছিলাম। সে বলল, আমি সব জানতাম, অনেক ভেবেছি আসি। কিন্তু সাহস হয় নি।
এসে কী করতে? না, কী আর করতাম। তবু হঠাৎ ইচ্ছে হত। আমি আপনাদের সবাইকে চিনি। ও আমাকে বলেছে।
কী বলেছে?
মেয়েটি মুখ নিচু করে হাসল। বলল, আপনাদের একটা কুকুর ছিল, পলা।
হ্যাঁ, শুধু পলাতক হত, তাই তার নাম পলা।
আচ্ছা, ওর কী সাজা হবে?
বারো-তোরো বৎসরের সাজা হবে হয়তো।
ফাঁসি হবে না তো?
না। উকিল বলছেন কম বয়স, আর রাগের মাথায় খুন।
ওর বুঝি খুব রাগ?
তোমার কী মনে হয়?
মেয়েটি হাসল কথা শুনে। বলল, জানি না। আমি যাই।
আবার এস।
আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগল আমার।
কেন?
ও আপনাকে খুব ভালোবাসত। আমার কাছে সব সময় বলত আপনার কথা।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ, ও তো মিথ্যা বলে না।
মেয়েটি চলে গেল। মন্টু হয়তো আমাকে খুব শ্রদ্ধা করত। বড়ো চাপা ছেলে, বোঝবার উপায় নেই। তবে শ্রদ্ধা করত ঠিকই। না, শ্রদ্ধা নয়, ভালোবাসা বলা যেতে পারে।
মনে পড়ল এক দিন সন্ধ্যায়। রুনু এসে আমায় বলল, দাদা, মন্টু আজ বাসায় আসবে না, আমায় বলে দিয়েছে। সে কাঁঠালগাছে বসে আছে।
কেন রে?
ও শার্ট ছিঁড়ে ফেলেছে মারামারি করে। তাই আমায় বলেছে, তুমি যদি ওকে আনতে যাও, তবেই আসবে।
প্রবল ভালোবাসা না থাকলে সন্ধ্যাবেল বসে কেউ প্রতীক্ষ্ণ করে না।–কখন বড়ো ভাই এসে গাছ থেকে নামিয়ে বাড়ি নিয়ে যাবে।
মন্টুর চলে যাবার পরপরই বাবা মন্টুর ঘরে তালা লাগিয়ে দিয়েছেন। কত দিন আর হল মন্টু গিয়েছে, তবু মনে হয় অনেক দিন ধরেই এই ঘরে একটি মাস্টারলক ঝুলে আছে। একটু আগে যে-মেয়েটি এসেছিল, সে মন্টুর ঘর দেখতে চায় নি। কে জানে সে-ঘরের কোথাও হয়তো এই মেয়েটির লেখা দ-একটা চিঠি মলিন হয়ে পড়ে আছে। আমি মন্টুর ঘরের তালা খুলে ফেললাম। পশ্চিম দিকের জানালা খুলতেই এক চিলতে হলুদ রোদ এসে পড়ল ঘরে। পাশাপাশি দুটি চৌকি। কাকার জিনিসপত্র কিছু নেই। সমস্তই পুলিশ সিজ করে নিয়েছে। মন্টুর বিছানা, কভারছাড়া বালিশ, দড়িতে ঝোলান শার্ট-প্যান্ট সব তেমনি আছে। বাঁশের তৈরী ছাপড়ায় সুন্দর করে খবরের কাগজ সাঁটা। ঝুঁকে পড়ে তাকাতেই নজরে পড়ল টিপকলম দিয়ে লিখে রেখেছে দিন যায় দিন যায়। কী মনে করে লিখেছিল কে জানে!
মন্টু
সতের তারিখ মন্টুর ফাঁসির হুকুম হল। ঠাণ্ডা মাথায় খুন, অনেক আই উইটনেস। কলেজে পড়া বিবেক-বুদ্ধির ছেলে। জজ সাহেব অবলীলায় হুকুম করলেন।
সেপ্টেম্বরের নয় তারিখ মাসি-পিটিশন অগ্ৰাহ্য হল। আমি জানলাম আঠার তারিখ ভোর-রাতে তার ফাঁসি হবে। তার লাশ নিতে হলে সেই সময় জেলগেটের সামনে জেলারের চিঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।