ছাই গুণেছ। বল আমার ভাগ্য।
আপনার জন্মলগ্নে আছে মঙ্গল আর রবির প্রভাব। সৌভাগ্যবতী আপনি। ভাগ্যবান ছেলে হবে আপনার।
বড়োমা হো হো করে হেসে উঠতেন।
মাথার ঠিক নাই তোমার। এই তোমার ভাগ্য গণনা? এই সব বুঝি লেখা বইএ? পুড়িয়ে ফেল তোমার বই। না হয় আমাকে দিও, আমি আগুন করে তোমাকে চা বানিয়ে দেব।
কাকা বিমর্ষ হয়ে বই-এর পাতা ওন্টাতেন। এইখানেই তাঁর গণনা মিলত না। বাবা বড়োমার ছেলে হওয়ার কোনো আশা না দেখেই দ্বিতীয় বার বিয়ে করেছিলেন।
আশ্চৰ্যভাবে কাকার গণনা মিলে গেল এক সময়। রুনুর জন্মের পাঁচ বৎসর আগেই বড়োমার কোলে এল মন্টু। বড় মা ভীষণ অবাক হয়েছিলেন কাকার নির্ভুল গণনা দেখে। কাকাকে ডেকে বললেন, আমার ছেলের ভাগ্যটা একটু দেখি মাস্টার। আশ্চৰ্য, এসব শিখলে কী করে? আমার শিখতে ইচ্ছে হচ্ছে।
মাস্টার কাকা হেসে বলেছিলেন, এও এক ধরনের বিজ্ঞান বুবু। অন্ধকার বিজ্ঞান। আপনি যদি শিখতে চান…
বড়োমা অসহিষ্ণু হয়ে বলেছিলেন, আগে আমার ছেলের ভাগ্য বল। তারপর তোমার অন্ধকার বিজ্ঞান।
কাকা বললেন, জন্ম হয়েছে। মঘা নক্ষত্রযুক্ত সিংহ রাশিতে চন্দ্রের অবস্থানকালে। জন্মসময় আকাশে কুন্তলীন। জাতক শনির ক্ষেত্রে রবির হোরায় বুধের দ্রেক্কাণে শুক্রের সপ্তমাংশে…
আহা, কি আরোলতাবোল শুরু করলে, ফলাফলটা বল।
ছেলে বুদ্ধিমান,সাহসী, শক্তিমান আর প্রেমিক। সৌভাগ্যবান ছেলে আপনার। তাকে একটা গোমেন্দ পাথর দেবেন। বুকু, খুব কাজে লাগবে।
বড়োমা মন্টুকে এগারো বৎসরের রেখে মারা গেলেন। মন্টুর জন্যে গোমেদ পাথর আর নেওয়া হল না! সেই পাথর যদি থাকত, আরু বে কি এই বিপদ এড়াতে পারত মন্টু?
আদালতে কৌতূহলী মানুষের ভিড়। জজসাহেব মনে হল বিশেষ কিছু শুনছেন না। সিগারেটের ধোঁয়া, ঘামের গন্ধ, লোকজনের মৃদু কথাবার্তা–সব মিলিয়ে অন্যরকম পরিবেশ গুমোট গরম, যদিও মাথার উপর দুটি নড়বড়ে রং ওঠা। ফ্যান কা-ক্যা শব্দ করে ঘুরছে। কালো গাউন পরা উকিলরা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন। মন্টু সরাসরি তাকিয়ে আছে সামনে। বাবা, আমি আর রুনু বসে আছি জড়সড় হয়ে। মন্টুকে দেখলাম মুখে হাত চাপা দিয়ে কয়েক বার কাশল।
আপনি বলছেন খুন করার ইচ্ছে হঠাৎ হয় নি, কিছুদিন থেকেই মনে ছিল?
হ্যাঁ।
কত দিন থেকে?
কত দিন থেকে আমার মনে নেই।
কিন্তু কী কারণে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করার ইচ্ছে হল?
কারণ আমার মনে নেই!
আপনি অসুস্থ?
না, আমি সুস্থ।
ক্রস-একজামিনেশনের শুরুতেই বাবা উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ তিনি শব্দ করে কেঁদে ফেললেন। সবাই তাকাল তাঁর দিকে। আদালতে মৃদু গুঞ্জন সরব হয়ে উঠল। জজ সাহেব বললেন, অর্ডার অর্ডার। তার কিছুক্ষণ পরই আদালত সেদিনের মতো মুলতবি হয়ে গেল। মা কাঁপা গলায় বললেন, বিচার শেষ হবে কবে খোকা?
চারদিকে বড়ো বেশি নির্জনতা। বড়ো বেশি নীরবতা। মন্টুর ঘরে বাবা একটা তালা লাগিয়েছেন। রুনুর বিছানায় রুনু এক-একা অনেক রাত অবধি জেগে থাকে। বাতি জ্বালান থাকলে আগে ঘুমুতে পারত না সে। এখন সারা রাত বাতি জ্বলে। হ্যাঁরিকেনের আবছা আলোয় সমস্তই কেমন ভূতুড়ে দেখায়। ঘরের দেয়ালে আমার মাথার একটা প্রকাণ্ড কালো ছায়া পড়ে। মাঝে মাঝে বাবা গোঙানির মতো শব্দ করে কাঁদেন। রুনু আঁৎকে উঠে বলে, কী হয়েছে দাদা? আমি চুপ করে থাকি।
রুনু আবার বলে, দাদা, কী হয়েছে?
বাবা কাঁদছেন।
বাবা গোঙানির মতো শব্দ করে কাঁদেন। বারান্দায় কী অপরূপ জ্যোৎস্না হয়! হানুহেনার সুবাস ভেসে আসে। কুনু বলে, মরার পর কী হয় দাদা?
আমি উত্তর দিই না। মনে মনে বলি, কিছুই হয় না। সব শেষ। যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের-মানুষের হয়না কো দেখা-। অসংলগ্ন কত কথাই মনে ७ाटन!
দাদা, মন্টু ভাইয়ের কী হবে?
জানি না।
ঘরের দেয়ালের লম্বা ছায়াগুলির দিকে তাকিয়ে আমার বুক হুঁহু করে। নাহার ভাবী মৃদু ভলুমে গান শোনেন, বিধি ডাগর আখি যদি দিয়েছিল, সে কি আমারি পানে ভুলে পড়িবে না। কান পেতে শুনি।
মাঝে মাঝে নাহার ভাবী আসেন আমার ঘরে। বিষণ্ণ হয়ে বসে থাকেন। সেদিনও এসেছিলেন। আমি জানালা বন্ধ করে বসেছিলাম। বাইরে কী তুমুল বৃষ্টি! বিকেলের আলো নিভে গিয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে আগেভাগে। নাহার ভাবী রুনুর বিছানায় এসে বসলেন।
আমি পরশু চলে যাচ্ছি।
আমি চমকে বললাম, কোথায়?
প্রথমে বাবার কাছে যাব। সেখান থেকে বাইরেও যেতে পারি দাদার সঙ্গে, ও চিঠি লিখেছে। যেতে।
আমি চুপ করে রইলাম। নাহার ভাবী বললেন, আপনাদের কথা খুব মনে থাকবে আমার। আপনাদের সবাইকে আমার বড়ো ভালো লেগেছে। রাবেয়ার কথা খুব মনে হয় আমার।
নাহার ভাবী চোখ মুছলেন। রুনুচা নিয়ে এল দু কাপ। নাহার ভাবী চায়ে চুমুক দিয়ে ধরা-গলায় হঠাৎ করেই বললেন, আপনার যদি আপত্তি না থাকে, মন্টু এমন কাজ কেন করল বলবেন? অনেকে অনেক কথা বলে। আমার খারাপ লাগে শুনে। আপনাদের আমি বড্ড ভালোবাসি।
মুম্বালাম, রাবেয়ার মৃত্যুর কারণটা তো আপনি জানেন ভাবী।
জানি।
কাকাই হয়তো দায়ী ছিলেন, মন্টু জেনেছিল। অবশ্যি মন্টু বলে নি কিছুই।
মন্টুর সঙ্গে দেখা হলে বলবেন, আমি সব সময় তার জন্যে দোওয়া করব। তাকে আমি ভালো করে দেখিও নি কোনো দিন।
ভাবী, মন্টু বড়ো চুপচাপ ছেলে।
আমার দোওয়ায় কিছু হবে না। তবু আমি তার জন্যে দোওয়া করব।