বললাম তো আমি বেচব না।
মন্টু দিয়ে দে, এমন করছিস কেন?
রাবেয়া সব সময় পলাকে নিয়ে বেড়াতে বেরুতি। পরিচিত। ঘরবাড়িতে গিয়ে বলত, খালাম্মা আমার পলাকে একটু দুধ দিন। আহা, চিনি দিয়ে দিন। শুধু শুধু দুধ বুঝি কেউ খায়?
মন্টু এক দিন একটা টিয়। পাখির বাচ্চা আনল কোথা থেকে। সেটি বাচ্চা হলেও খুব চমৎকার ছিল দেখতে। বারান্দায খাঁচা বুলিয়ে পাখিটিকে রাখা হত। ঠাণ্ডা লেগে এক দিন সেটি মারা গেল। মন্টু পাখির শোকে এক বেলা ভাত খেল না।
মন্টু আর মাস্টার কাকা সবচেয়ে ছোট ঘরটায় থাকতেন। ঘরটায় আলো আসত না ভালো। গরমের সময় গুমোট গরম। বাতাস আসার পথ নেই। মন্টুর হাজতবাসের দিনগুলি এখন কেমন কাটছে? মন্টু বয়স এখন উনিশ, সাত বাদ দিলে হয় বারো। বারো বৎসর সে আর মাস্টার কাকা একসঙ্গে একটি ঘরে কাটিয়েছে। মাস্টার কাকার অভাব সে অনুভব করছে কি? খুনের পর শুনেছি। অনেকে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যায়। দিনরাত্তির খুন করা লোকের চেহারা, খুনের দৃশ্য চোখের সামনে ভাসতে থাকে। মন্টুর সে-রকম হবে না। তার বড়ো শক্ত নাৰ্ভ। মন্টুর মা, আমাদের বড়োমা যেদিন মারা গেলেন, মন্টু সেদিন নিতান্ত সহজভাবেই কাটাল। পরদিন শিমুলতলা গাঁয়ে ফুটবল ম্যাচ দেখতে গেল বাসায় কাউকে না বলে। বয়স অল্প ছিল। শোক বোঝবার বুদ্ধিই হয়তো হয় নি। কিন্তু আমার মনে হয় কম বয়সের জন্যে নয়। বড়োমার মতো তারও ইস্পাতের মতো শক্ত নাৰ্ভ ছিল। মন্টু দেখতে অনেকটা বড়োমার মতো। তার চাইবার ভঙ্গি, কথা বলার ভঙ্গি, সমস্তই বড়োমায়ের মতো। বাবার শোবার ঘরে বড়োমা আর বাবার একটা যৌথ ছবি আছে। বিয়ের ছবি। সেই ছবির দিকে তাকালেই মন্টুকে চেনা যায়। ছবির কাচে ময়লা জমে ছবিটা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। তবু বড়োমার বালিকা বয়সের ছবি আমাদের আকর্ষণ করে। চৌঠা আগষ্ট আমাদের বাসায় একটা উৎসব হয়। ভুল বললাম, শোকের আসর হয়। বাদ-মাগরেব মিলাদ পড়ান হয়। বাবা বড়োমায়ের কবর জিয়ারত করেন। দু-একটি ফকিরমিসকিনকে খাওয়ান হয়। হাউমাউ করে বাবা বড়োমায়ের মৃত্যুদিন স্মরণ করে কিছুক্ষণ কাঁদেন। তাঁর শোকটা নিশ্চয়ই আন্তরিক, তবু সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন হাস্যকর লাগে। বিশেষ করে এই দিনটিতে মা মুখ কালো করে ভয়ে-ভয়ে ঘুরে বেড়ান। তাঁর ভাব দেখে মনে হয় চৌঠা আগষ্টের এই শোকের দিনটির জন্যে মা নিজেই দায়ী। বাবা সেদিন অতি সামান্যতম অতি তুচ্ছতম ব্যাপারেও মায়ের উপর ক্ষেপে যান। আমার কষ্ট হয়। বড়োমা আমাদের সবারই অতি শ্রদ্ধার মানুষ। রাবেয়া আর আমি অনেক দিন পর্যন্ত তাঁকে জড়িয়ে না ধরে ঘুমুতে পারি নি। যখন বয়স হয়েছে, তাঁর কোলে এসেছে মন্টু। আমি আর রাবেয়া দক্ষিণের ঘরে নির্বাসিত হয়েছি, তখনো তিনি মাঝে মাঝে এসে বলতেন, খোকা আজ তুই শুবি আমার সাথে। আগে আমার সঙ্গে ঘুমাবার জন্যে এত হৈচৈ করতিস, এখন যে বড়ো চুপচাপ?
বড়ো হয়েছি যে।
ওহ, কী মস্ত বড়ো ছেলে।
বড়োমার গলা জড়িয়ে তার বিরফি-কাটা ছাপের ব্লাউজে নাক ড়ুবিয়ে প্রতি সন্ধ্যায় আবদার, গল্প বলেন বড়োমা। ভূতের গল্প।
বড়োমা কোমল কণ্ঠে ধীরে ধীরে গল্প বলতেন, আমরা তখন ছোট। বারোতের বৎসরের বেশি বড়ো নয়। নানার বাড়ি যাচ্ছি। সবাই। ভাদ্র মাস, নদী কানায় কানায় ভরা। সারা দিন নৌক চলল। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মাঝিরা পুরান এক তালগাছের সঙ্গে নৌকা বেঁধে রান্না বসিয়েছে। এমন সময় রুস্তম বলে যে—বুড়ো মাঝিাঁটা ছিল, তার সে কি বিকট চিৎকার, কর্তা তালগাছে এটা কী? আমি শুনেই বাবাকে জাপ্টে ধরেছি। তালগাছের দিকে চাইবার সাহস নেই। বলতে বলতে বড়োমা থামতেন, আমরা ফুসে উঠতাম, থামলে কেন, বল শিগগির।
গল্প শুনে আতঙ্কে জমে যেতাম। কী অদ্ভুত তাঁর গল্প বলার ভঙ্গি! বড়োমার মৃত্যুর দিনটিতে বাবার হৈচৈ আমার তাই ভালো লাগত না। আমার মনে হত আড়ম্বরের চেয়ে মৌন দুঃখানুভূতিই হয়তো ভালো হত। আমি মনে মনে বললাম, বড়োমা তোমার ছেলের আজ বড়ো বিপদ।
হ্যাঁ, আজ মন্টুর বড়ো বিপদ। বড়ো ভয়ঙ্কর বিপদ। মন্টু কি বড়ো মাকে ডাকছে? ফুটবলের খুব নেশা ছিল মন্টুর। খেলতে গিয়ে পা ভেঙে ছেলেদের কাঁধে চড়ে বাসায় এল। হাঁটুর নিচে আধ-হাতখানেক জায়গা কালো হয়ে ফুলে উঠেছে। হৈচৈ শুনে বড়োমা বেরিয়ে আসতেই মন্টু বলল, মা, আমি পা ভেঙে ফেলেছি।
বড়োমা বললেন, সেরে যাবে।
মন্টুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। এক্সরে করে দেখা গেল ভেতরে হাড়ের একটা ছোট ছুঁচাল কণা ভেঙে রয়ে গেছে, কেটে বের করতে হবে।
মন্টুকে সাদা বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হল। এনেসথেসিয়া করার বড়ো চৌকো। ধরনের যন্ত্রটা ডাওগার মন্টুর মুখের কাছে নামিয়ে আনলেন। ছোট্ট মন্টু আতঙ্কে নীল হয়ে গেল। ডাক্তার বললেন, বল খোকা বল, এক দুই তিন চর। মন্টু বলল, মা, মা, মা।
আজ মন্টুর বড়ো বিপদ। দুৰ্গন্ধ কম্বলে মাথা চাপা দিয়ে আজো কি সে মা মা জপছে? না, মন্টু বড়ো শক্ত ছেলে। ইস্পাতের মতো তার নার্ভ। দারোগা সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আকন্দকে খুন করেছ?
জ্বি।
কী দিয়ে?
বঁটি দিয়ে, মাছ কাটা বঁটি।
কটা কোপ দিয়েছিলে?
মনে নেই।
মরবার সময়ে তিনি কিছু বলেছিলেন?
জ্বি।
কী বলেছিলেন?
বাবা মন্টু।
আর কিছু বলেন নি?
না।
তিনি কি তোমাদের খুব শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন?
জ্বি, ছিলেন।
তুমি কী করা?
বি. এ. পড়ছিলাম।