রুণু কখন-বা এসেছে। আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে সে। ঘরময় নষ্ট রক্তের একটা দম আটকান অস্বস্তিকর গন্ধ। রাবেয়া চোখ বুজে শুয়ে। তার মুখটা কী ফর্সাই না দেখাচ্ছে। বাবা বললেন, মা রাবু, একটু দুধ খাও।
না।
মাথায় পানি দেব মা?
না বাবা।
রাবেয়া চোখ মেলে বাবার দিকে তাকাল। বলল, বাবা।
কি মা?
আমার বুকটা খালিখালি লাগছে কেন?
সেরে যাবে মা।
তুমি আমার বুকে হাত রাখবে একটু? এইখানে?
এমনি করেই ভোর হল। মন্টু এল ছটায়।
সে হাতভম্ব হয়ে গেল। বাবা গিয়েছেন ইনজেকশন দেবার লোক আনতে। রাবেয়া মন্টুর দিকে তাকিয়ে বলল, মন্টু আমার অসুখ করেছে।
মন্টু বিস্মিত হয়ে চারদিকে তাকাচ্ছিল। রাবেয়া আবার বলল, মন্টু, আমার বুকটা খালিখালি লাগছে।
মন্টু রাবেয়ার মাথায় হাত রাখল। মা নিঃশব্দে কাঁদছেন। রুনু আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে। সকালের রোদ এসে পড়েছে জমাট-বাঁধা কালো রক্তে। রাবেয়া আমাকে ডাকল, খোকা, ও খোকা।
আমি তার কাছেই দাঁড়িয়ে আছি। নীল রঙের চাদরে ঢাকা রাবেয়ার শরীর নিষ্পন্দ পড়ে আছে। একটা মাছি রাবেয়ার নাকের কাছে ভনভন্ন করছে। রাবেয়া হঠাৎ করেই বলে উঠল, পলাকে তো দেখছি না। ও খোকা, পলা কোথায় রে? আমাদের চারদিকে উদ্বিগ্ন হয়ে পলাকে খুঁজলে সে। আর কী আশ্চৰ্য, বেলা নটায় চুপচাপ মরে গেল রাবেয়া। তখন চারদিকে শীতের ভোরের কী ঝকঝকে আলো!
গত বৎসর আমরা বড়ো খালার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। বড়ো খালার মেয়ে নিনাও এসেছিল মায়ের কাছে। প্রথম পোয়াতি মেয়ে। মা নিয়ে এসেছেন নিজের কাছে। নিনা আপা কি প্রসন্ন মনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন চারদিকে। প্রথম সন্তান জন্মাবে, তার কী প্রগাঢ় আনন্দ চোখে-মুখে। যদি ছেলে হয়, তবে তার নাম দেব কিংশুক, মেয়ে হলে রাখী। হোসে-হেসে বলে উঠেছিলেন নিনা আপা। আর তাতেই উৎসাহিত হয়ে রাবেয়া বলেছিল, আমিও আমার ছেলের নাম কিংশুক রাখব। আমরা সবাই হেসে উঠেছিলাম। রাবেয়া, নীল রঙের চাদর গায়ে জড়িয়ে তুই শুয়ে আছিস। হলুদ রোদ এসে পড়ছে তোর মুখে। কিংশুক নামের সেই ছেলেটি তোর বুকের সঙ্গে মিছে গেছে। যে—বুক একটু আগেই খালিখালি লাগছিল।
বারোটার দিকে ফিরে এলেন মাস্টার কাকা। সঙ্গে শহর থেকে আনা বড়ো ডাক্তার। আর মন্টু, দিনে-দুপুরে অনেক লোকজনের মধ্যে ফালা-ফালা করে ফেলল মাস্টার কাকাকে একটা মাছ-কাটা বঁটি দিয়ে। পানের দোকান থেকে দৌড়ে এল দু-তিন জন। এক জন রিকশাওয়ালা রিকশা ফেলে ছুটে এল। ওভারশীয়ার কাকুর বড়ো ছেলে জসীম দৌড়ে এল। ডাক্তার সাহেব চেঁচাতে লাগলেন, হেল্প! হেল্প! চিৎকার শুনে বাইরে এসে দাঁড়াতেই আমি দেখলাম, বঁটি হাতে মন্টু দাঁড়িয়ে আছে। পিছন থেকে তাকে জাপটে ধরে আছে কজন মিলে। রক্তের একটা মোটা ধারা গড়িয়ে চলেছে নালায়। মন্টু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দাদা, ওকে আমি মেরে ফেলেছি।
আমার মনে পড়ল, হাস্নুহেনা গাছের নিচে মন্টু এক দিন পিটিয়ে একটা মস্ত সাপ মেরেছিল।
রাবেয়াকে ঘিরে সবাই বসে ছিল। আমি ঢুকতেই নাহার ভাবী বললেন, বাইরে এত গোলমাল কিসের?
আমি মায়ের দিকে তাকালাম, মা, এইমাত্র মন্টু মাস্টার কাকাকে খুন করেছে। আপনি বাইরে আসেন। মন্টুকে থানায় নিয়ে যাচ্ছে সবাই।
হাস্নুহেনা গাছের নিচে মন্টু একটা মস্ত চন্দ্রবোড়া সাপ মেরেছিল। সাপের মাথায় গোল বেগুনি রঙের চক্র। চার হাতের উপর লম্বা। মন্টু, মরা সাপটাকে কাঠির আগায় নিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়াতেই ছোট বাচ্চারা উল্লাসে লাফাতে লাগল। রাবেয়া খুশিতে হেসে ফেলে বলল, মন্টু, কাঠিটা আমার হাতে দে।
পলা আনন্দে ঘেউঘেউ করছিল। মাঝে মাঝে লাফিয়ে সাপটিাকে কামড়াতে গিয়ে ফিরে আসছিল। রাবেয়া পলার দিকে তাকিয়ে শাসাল, এই পলা এই, মারব থাপ্পড়।
সাপটাকে সবাই মিলে পুকুরপাড়ে কবর দিতে নিয়ে গেল। মিছিলের পুরোভাগে রাবেয়া। তার হাতের কাঠিতে সাপটা আড়াআড়ি ঝুলছে। মন্টু পলাকে নিয়ে দলের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছিল। সাপের জন্য লম্বা করে কবর খোঁড়া হল। মন্টু পুকুরপাড়ে বিষণ্ণভাবে বসেছিল।
কাকাকে মেরে ফেলবার পর মন্টুকে সবাই জাপটে ধরে রেখেছিল। জসী মন্টুর হাত শক্ত করে ধরে চেঁচাচ্ছিল, পুলিশে খবর দিন। পুলিশে খবর দিন। মাছকাটার বঁটিটা কাৎ হয়ে ঘাসের উপর পড়ে আছে। সেখানে একটুও রক্তের দাগ নেই। কাকা যেখানে পড়ে ছিলেন, সেখান থেকে একটা মোটা রক্তের ধারা ধীরে ধীরে নালার দিকে নেমে যাচ্ছিল। মন্টু আমায় দেখে বলল, দাদা, ওকে আমি মেরে ফেলেছি।
মন্টু চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। আশেপাশে প্রচুর লোক জমা হয়ে গিজগিজ করছিল। মোটা ডাক্তার ভাঙা গলায় প্ৰাণপণে চেঁচাচ্ছিলেন, হেল্প! হেল্প! একটা পাংশুটে রঙের কুকুর মরা লাশটার কাছে ভিড়বার চেষ্টা করছিল।
মন্টুর কুকুরের রং ছিল সাদা। গলার কাছে কালো একটা ফুটকি। মন্টু কাঞ্চনপুর থেকে এনেছিল কুকুরটাকে। অল্প দিনেই ভীষণ পোষ মেনেছিল। মন্টু তাকে টুলকািঠ দিয়ে একটি চমৎকার ঘর বানিয়ে দিয়েছিল। আমি কুকুরটার নাম দিয়েছিলাম পলা। রাবেয়া মন্টুর কাছ থেকে আট আনা দিয়ে কিনে নিয়েছিল। মন্টুর বিক্রির ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু রাবেয়া পীড়াপীড়ি করছিল, মন্টু পলাকে আমি কিনব।
না। আপা, আমি পলাকে বেচব না।
আহা, দে না মন্টু। আট আনা পয়সা দেব আমি। দে না।