মা আমার চাকরি হয়েছে।
মা দৌড়ে এলেন। বহুদিন পর তাঁর চোখ আনন্দে ছলছল করে উঠল। বললেন, দেখি। আমি চিঠিটা তার হাতে দিলাম। মা পড়তে জানেন না, তবু উল্টেপান্টে দেখলেন সেটি। এমনভাবে নাড়াচাড়া করছিলেন, যেন খুব একটা দামী জিনিস হাতে। মা বললেন, বেতন কত রে?
সাড়ে চার শ।
বলিস কি? এত।
আমি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললাম, বেশি আর কোথায়? বলেই আমি লজ্জা পেলাম। ভালো করেই জানি, টাকাটা আমার কাছে অনেক বেশি। মা বললেন, এবার বিয়ে করাব তোকে।
কী যে বলেন।
বেশ একটি লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে আনতে হবে। রূপবতী কিন্তু সাধাসিধা, নাহার মেয়েটির মতো।
মা কল্পনায় সুখের সাগরে ড়ুব দিলেন।
শহরে তুই বাসা করবি?
তা তো করতেই হবে।
বেশ হবে, মাঝে মাঝে তোর কাছে গিয়ে থাকব।
মাঝে মাঝে কেন, সব সময়ে থাকবেন।
না রে বাপু, সংসার ফেলে যাব না।
মা ছেলেমানুষের মতো হাসলেন। আমি বললাম, প্রথম বেতনের টাকায় আপনাকে কী দেব মা?
তোর বাবাকে একটা কোট কিনে দিস, আগেরটা পোকায় নষ্ট করেছে।
বাবারটা তো বাবাকেই দেব, আপনাকে কী?
মা রহস্য করে বললেন, আমায় একটা টুকটুকে বউ এনে দে।
মাস্টার কাকাও খবর শুনে খুশি হলেন। তাঁর খুশি সব সময়ই মৌন। এবার একটু বাড়াবাড়ি ধরনের আনন্দ করলেন। নিজের টাকায় প্রচুর মিষ্টি কিনে আনলেন। অনেক মিষ্টি। যার যত ইচ্ছে খাও। কাকা বললেন, সুখ আসতে শুরু করলে সুখের বান ডেকে যায়, দেখো খোকা, কত সুখ হবে তোমার।
রুনু স্কুল থেকে এসে বলল, দাদা, তোমার নাকি বিয়ে?
কে বলেছে রে?
মা, হি হি।
খুব হি হি, না? তোকে বিয়ে দি যদি?
যাও, খালি ঠাট্টা। কাকে তুমি বিয়ে করবে দাদা?
দেখি ভেবে!
আমি জানি কার কথা ভাবছি।
কার কথা?
শীলার কথা নয়?
পাগল তুই!
অবহেলায় উড়িয়ে দিলেও বুঝতে পারছি, আমার কান লাল হয়ে উঠছে। অস্বস্তি বোধ করছি। শীলুকে কেন যে হঠাৎ ভালো লাগল। যত বার তাকে দেখি, তত বার বুক ধ্বক করে ওঠে। একটা আশ্চর্য সুখের মতো ব্যথা অনুভব করি। সমস্ত শরীর জুড়ে শীলুশীলু করে কারা বুঝি চেঁচায়। আমি একটু হেসে বলি, কে ভাবে তোর শীলুর কথা?
না, এমনি বলছি মা। বড়ো ভালো মেয়ে শীলু।
হুঁ। তুই কাকে বিয়ে করবি রুনু?
যাও দাদা, ভালো হবে না বলছি।
আমার এক জন বন্ধু আছে, খুব ভালো ছেলে–
দাদা, আমি কিন্তু কেঁদে ফেলব এবার।
আনন্দ-অনুষ্ঠান থেকে মন্টু বাদ পড়ল। বড়ো নানার বাড়িতে গিয়েছে সে, আগামী কাল আসবে। বাবা এলেন রাত নটার দিকে। মা খবরটা না দিয়ে মিষ্টি খেতে দিলেন বাবাকে।
মিষ্টি কিসের?
আছে একটা ব্যাপার।
বাবা আধখানা মিষ্টি খেলেন, ব্যাপার জানার জন্যে উৎসাহ দেখালেন না। মা নিজের থেকেই বললেন, খোকার চাকরি হয়েছে। সাড়ে চার শ টাকা মাইনে।
বাবা খুশি হলেন। থেমে থেমে বললেন, ভালো হয়েছে। আমি চাকরি ছেড়ে দেব এবার। বয়স হয়েছে, আর পারি না। রাবেয়া, রাবেয়া কোথায়?
ঘুমিয়েছে, শরীর খারাপ।
ভাত খায় নি তো?
না, একটা মিষ্টি খেয়েছে শুধু।
আহ্! বললাম খালিপেটে রাখতে, মিষ্টিই—বা দিলে কেন?
সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়লাম সেদিন। রাত একটার দিকে মা পাগলের মতো ডাকলেন, খোকা, ও খোকা।–শিগগির ওঠ। ও খোকা, খোকা।
খুব ছোটবেলায় গভীর রাতে একবার মা এমন ব্যাকুল হয়ে ডেকেছিলেন। ভূমিকম্প হচ্ছিল তখন। আমাদের বাসা থেকে চল্লিশ গজের ভিতর নদী সাহেবদের ছেড়ে-যাওয়া পুরানো বাড়ি ধ্বসে পড়ে গিয়েছিল। আজকের এই গভীর রাতে মায়ের আতঙ্কিত ডাক আমাকে ভূমিকম্পের কথা মনে করিয়ে দিল। দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াতেই মা বললেন, আয় আমার ঘরে, আয় তাড়াতাড়ি।
কী হয়েছে?
মা অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছিলেন। তিনি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চললেন। দরজা খোলা, চোখে পড়ল মায়ের বিছানায় রাবেয়া শুয়ে আছে। তার মাথার কাছে বাবা গরুর মতো চোখে তাকিয়ে আছেন। রক্তে মেঝে ভেসে যাচ্ছে। আমি থমকে দাঁড়ালাম। এ্যাবোরশান নাকি? কাকে দিয়ে কি করালেন? নাকি নিজে নিজেই কিছু খাইয়ে দিয়েছেন? বাবা ধরা-গলায় বললেন, খোকা, তুই মাথায় একটু হাওয়া কর, আমি এক জন বড়ো ডাক্তার নিয়ে আসি। রক্ত বন্ধ হচ্ছে না।
ডাক্তার এলেন এক জন। গম্ভীর হয়ে ইনজেকশন করলেন।
আপনার মেয়েকে আমি চিনি।
বাবা ডাক্তারের হাত চেপে ধরলেন, বড়ো দুঃখী মেয়ে, মেয়েটাকে আপনি বাঁচান ডাক্তার।
ডাক্তার সেন্টিমেন্টের ধার দিয়েও গেলেন না। এক গাদা ঔষধ দিয়ে গেলেন। সকালে আরো দুটো ইনজেকশন করতে বললেন। দশটার দিকে তিনি আসবেন।
বাবা হাঁপাতে-হাঁপাতে বললেন, কেউ জানবে না তো ডাক্তার?
ডাক্তার বললেন, মান ইজ্জত পরের ব্যাপার, আগে মেয়ে বাঁচুক।
রাবেয়া চি চি করে বলল, মা, আমার কী হয়েছে?
কিছু হয় নি, সেরে যাবে, চুপ করে শুয়ে থাক।
বুকটা খালিখালি লাগছে কেন?
সেরে যাবে মা, দুধ খাবে একটু?
না।
আমি আচ্ছন্নের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। ঘরে লম্বালম্বি একটা ছায়া পড়ল। তাকিয়ে দেখি মাস্টার কাকা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। একটু কাশলেন তিনি। বাবা হাউমাউ করে কেঁদে বললেন, শরীফ মিয়া, আমার মেয়েটাকে বাঁচাও।
মাস্টার কাকা মৃদু গলায় বললেন, শহর থেকে খুব বড়ো ডাক্তার আনব আমি। খোকা, তোর সাইকেলটা বের করে দে।
আমি বললাম, আমি যাই কাক?
না, তুমি গুছিয়ে বলতে পারবে না। তুমি থাক।
বাবা ধমকে উঠলেন, ওর কথা শুন না। ও একটা পাগল-ছাগল। তুমি যাও। নিজেই যাও।