বাবা মার দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বললেন, এখন কী করবে?
ব্যাপারটা আমি জানলাম। রুনু জানল। মন্টু ফুটবল খেলতে বাইরে গেছে, শুধু সে-ই জানল না। রাবেয়ার নির্বিকার ঘুরে বেড়ানর ফল ফলেছে। ডাক্তার তাকে পরিশ্রম করতে নিষেধ করেছেন। এখন রাবেয়ার প্রয়োজন শুধু বিশ্রাম।
রাবেয়ার মাথার ঠিক নেই। ছোটবেলা থেকেই সে ঘুরে বেড়ােত চারদিকে। সব বাড়িঘরই তার চেনা। চাচা খালু দাদা বলে ডাকে আশেপাশের মানুষদের। তাদের ভিতর থেকেই কেউ তাকে ডেকে নিয়েছে। এমন একটি মেয়েকে প্রলুব্ধ করতে কী লাগে? মোর রাত্রে ঘুম হয় না। তাঁর চোখের নিচে গাঢ় হয়ে কালি পড়েছে। রুনু আর শীলুদের বাসায় গান শুনতে যায় না। নাহার ভাবী বেড়াতে এসে বললেন, কি ব্যাপার, তোমরা কেউ দেখি আমাদের ওখানে যাও না, রাবেয়া পর্যন্ত না।
রুলু কথা বলে না। মা নিচু গলায় বলেন, রাবেয়ার অসুখ করেছে মা।
কি অসুখ, কই জানি না তো?
এমনি শরীর খারাপ।
বলতে গিয়ে মায়ের কথা বেধে যায়। অসহায়ের মতো তাকান।
ব্যাপারটার উৎস রাবেয়ার কাছ থেকে জানতে চেষ্টা করলাম। আমি। সন্ধ্যায় যখন রুনু মাস্টার কাকার কাছে পড়তে যায়, ঘরে থাকি আমি আর রাবেয়া। তখনই আমি কথা শুরু করি :
রাবেয়া।
কি?
কোথায় কোথায় বেড়াতে যাস তুই?
কত জায়গায়। চেনা বাড়িতে।
খুব ভালো লাগে?
হুঁ।
কাকে কাকে ভালো লাগে?
সবাইকে!
ছেলেদের ভালো লাগে?
হুঁ।
নাম বল তাদের।
একটানা নাম হলে চলে সে। তাদের কাউকেই সন্দেহভাজন মনে হয় না। আমার। সবাই বাচ্চা বাচ্চা ছেলে। রাবেয়াকে বড়ো আপা ডাকে।
তারা তোকে আদর করে, রাবেয়া?
হুঁ।
কী করে আদর করে?
আমার সঙ্গে খেলে, আর—
আর কি?
গল্প করে।
কিসের গল্প?
ভূতের।
ইতস্তত করে বলি, তোকে কেউ চুমু খেয়েছে রাবেয়া?
যাহ! তাই বুঝি খায়?
মার কথাগুলি হয় আরো স্পষ্ট, আরো খোলামেলা। আমার লজ্জা করে। মা আদুরে গলায় বলেন, রাবেয়া, কে তোর শাড়ি খুলেছিল? বল তো নাম।
যাও মা, তুমি তো ভারি…
মা রেগে যান। হপাতে হাঁপাতে বলেন, তাহলে এমন হল কেন? বল তুই হারামজাদী?
রাবেয়া বলে না কিছু, মা ফুঁপিয়ে—ফুঁপিয়ে কাঁদেন। রাবেয়া বড়ো বড়ো চোখে তাকায়। বলে, কাঁদা কেন, মা?
বল, কার সঙ্গে তুই শুয়েছিলি?
রাবেয়া চুপ করে থাকে। কথাই হয়তো বুঝতে পারে না। বাবা পাগলের মতো হয়ে উঠেছেন। মেজাজ হয়েছে খিটখিটে, অল্পতেই রেগে বাড়ি মাথায় তোলেন। রুনু স্কুল থেকে ফিরতে দেরি করেছে বলে মার খেল সেদিন। এক দিন দেখি বাবা গণক নিয়ে এসেছেন, পাড়ার সব যুবকদের নাম লিখে কী-সব মন্ত্র পড়ছে সে।
রাবেয়ার অসুখের প্রত্যক্ষ চিহ্ন ধরা পড়ল এক দিন ভোরে। চা খেয়েই ওয়াক ওয়াক করে বমি করল সে। যদিও তার শারীরিক অস্বাভাবিকতা নজরে আসার সময় এখনো হয় নি, তবু তার শরীরে আলগা শ্ৰী আসছিল। একটু চাপা গাল ভরাট হয়ে উঠছে, ভুরু মনে হচ্ছে আরো কালো, চোখ হয়েছে উজ্জ্বল, চলাফেরায় এসেছে এক স্বাভাবিক মন্থরতা। স্কুলের হেড-মাস্টারের বউ এক দিন বেড়াতে এসে বললেন, দেখ ও বউ, তোমার মেয়ে কেমন হাঁটছে–ঠিক যেন পোয়াতি।
কথাগুলি আমার বুকে ধক করে বিধেছে। কিছু একটা করতে হবে এবং খুব শিগগিরই। সবার জানিবার ও বুঝবার আগে। একটি করে দিন যাচ্ছে, অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সবাই। কিন্তু কী করা যায়? বাবা নিশ্চয়ই কিছু একটা ভেবেছেন। এক বার ইচ্ছে হয় তাঁকে জিজ্ঞেস করি, কিন্তু সাহসে কুলোয় না। বাবাকে বড়ো ভয় করি আমরা।
সেদিন রাতে শুনলাম। বাবা চাপা কণ্ঠে বলছেন, বিষ খাইয়ে মেরে ফেল মেয়েকে। মা বললেন, ছিছি, বাপ হয়ে এই বললে? বাবা বিড়বিড় করে বললেন, আমার মাথার ঠিক নেই শানু, তুমি কিছু মনে করো না। পাগল মেয়ে আমার! বাবার দীর্ঘনিঃশ্বাস শুনলাম। অনেক রাত অবধি ঘুম হল না। আমার। একসময় রাবেয়া ঘুম ভেঙে জেগে উঠল। কাতর গলায় বলল, খোকা।
কি? বাথরুমে যাবি?
উঁহু!
কী হয়েছে? খারাপ লাগছে?
হ্যাঁ।
বমি করবি?
না।
স্বপ্ন দেখেছিস?
হুঁ।
কী স্বপ্ন?
মনে নেই।
ঘুমিয়ে পড়, ভালো লাগবে।
আচ্ছা।
রাবেয়া শুয়ে পড়ল আবার। মুহুর্তেই উঠে বসে বলল, খোকা।
কি?
পলা এসেছে।
কে এসেছে?
পলা। দোর খুলে দেখ, বারান্দায় বসে আছে। আমি ডাক শুনলাম।
দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম দু জনেই। কোথায় কি? খা-খাঁ করছে চারদিক। রাবেয়া ডাকল, পলা, পলা।
মা বললেন, কে কথা বলে?
আমি রাবেয়া, মা।
বাবা ধমকে উঠলেন, যাও যাও, ঘুমুতে যাও! কী কর এত রাত্ৰে?
শব্দ শুনে মাস্টার কাকা বাইরে আসেন।
কী হয়েছে খোকা?
রাবেয়া বলে, পলাকে ডাকছিলাম কাকা।
যাও শুয়ে পড়, পলা কোথেকে আসবে এত রাত্তিরে?
শুতে শুতে রাবেয়া বলল, খোকা, পলাকে একটা চামড়ার বেল্ট কিনে দেবে? গলায় বেধে দেব।
আচ্ছা!
আর একটা লম্বা শিকল কিনে দেবে?
দেব!
আচ্ছা, আর একটা জিনিস দেবে?
কি জিনিস?
নাম মনে নেই আমার। দেবে তো?
আচ্ছা দেব।
কবে? কাল?
না, চাকরি হোক আগে।
বাবা বলে উঠলেন, কি ভ্যাজর ভ্যাজর করছিস তোরা? ঘুমো। সারা দিন খেটে এসে শুই, তাও যদি শান্তি পাওয়া যায়।
চাকরি
বহু আকাঙ্ক্ষিত চিঠিটি এল। সরকারী সীল থাকা সত্ত্বেও কিছুই বুঝতে পারি নি। আর দশটা খাম যেমন খুলি, তেমনি আড়াআড়ি খুলে ফেললাম। আমাকে তাঁরা ডাকছেন। রসায়নশান্ত্রের লেকচারারশিপ পেয়েছি, একটি কলেজে। প্রাথমিক বেতন সাড়ে চার শ টাকা, ইয়ারলি পাঁচশ টাকা ইনক্রিমেন্ট। লেখাগুলি কেমন অপরিচিত মনে হচ্ছিল। খুব খুশি হয়েছি। এমন একটা অনুভূতি আসছিল না। অথচ আমি সত্যি খুশি হয়েছি। এবং আমি সবাইকে সুখী করতে চাই। সীতাকুণ্ডের পাহাড়ে সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যেতে চাই, বুনুকে গাঢ় সবুজ একটি শাড়ি দিতে চাই, রোল নাম্বার থাটিন-এর গায়ে যেমন দেখেছি। এখন হয়তো সমস্তই আমার মুঠোয়, তবু সেই অগাধ সুখ, সমস্ত শরীর জুড়ে উন্মাদ আনন্দ কই? আমরা বহু কষ্ট পেয়ে মানুষ হয়েছি। আমাদের ছেলেমানুষি কোনো সাধ, কোনো বাসনা আমার বাবা-মা মেটাতে পারেন নি। আমাদের বাসনা তাঁদের দুঃখই দিয়েছে। আজ আমি সমস্ত বেদনায় সমস্ত দুঃখে শান্তির প্রলেপ জুড়াব। আলাদীনের প্রদীপ হাতে পেয়েছি, শক্তিমান দৈত্যটা হাতের মুঠোয়।