আমি নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখতে প্ৰাণপণ চেষ্টা করে বললাম, হ্যাঁ।
তোমার কাছে ওকে ভালো লাগে?
তা লাগে।
কিন্তু, ও কী বলে জান?
কী বলে?
বলে তোমার দাদাভাইকে দেখলেই মনে হয় বোকা, তাই না?
বলা বাহুল্য আমি সেদিন দুঃখিত হয়েছিলাম। আমাকে কেউ বোকা বলছে, সেই জন্যে নয়। আমার গভীর আবেগের কথা সে জানছে না, এই জন্যে। আমার ধারণা, শীলু। যখন সমস্ত কিছু জানবে, তখন নিশ্চয়ই আমাকে অন্য চোখে দেখবে। আমি বললাম, শুনে তোর খারাপ লেগেছে, রুনু?
হ্যাঁ।
শীলু কি তোর খুব ভালো বন্ধু?
হ্যাঁ, ভালো বন্ধু।
আমাদের সংসার
আমাদের সংসারে কী–একটা পরিবর্তন এসেছে। সুর কেটে গেছে কোথাও। শীলু আমার সমস্ত চেতনা এমনভাবে আচ্ছান্ন করে রেখেছে যে, আমি ঠিক কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। মা ভীষণরকম নীরব হয়ে পড়েছেন। শঙ্কিতভাবে চলাফেরা করছেন। তাঁর হতাশ ভাবভঙ্গি, নিচু সুরে টেনে–টেনে কথা বলা সমস্তই বলে দেয় কিছু একটা হয়েছে। বাবা এসে প্রায়ই আমার ঘরে বসেন। নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় দু— একটি কথাবার্তা বলেন : কেমন পড়াশোনা চলছে? বাজারের জিনিসপত্রের যা দাম!
আমি তাঁর ভাবভঙ্গি দেখেই বুঝতে পারি, তিনি কিছু একটা বলতে চান। এলোমেলো কথা বলতে-বলতে এটি সেটি নাড়তে থাকেন, তারপর হঠাৎ করে উঠে চলে যান। কী বলতে চান তা বুঝে উঠতে পারি না। বাবাকে আমরা বড়ো ভয় পাই, নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস পাই না। মাকে যখন জিজ্ঞেস করি, কি হয়েছে মা? মা অবাক হবার ভান করে বলেন, হবে। আবার কি রে খোকা?
মা মিথ্যা বলতে পারেন না, কিছু লুকোতে পারেন না। আমি জোর দিয়ে বলি, বল, কী হয়েছে?
মা মেঝের দিকে তাকিয়ে টানা সুরে কাঁপা গলায় বললেন, কোথায় কি হায়েছে?
অথচ প্রায়ই দেখছি বাবা আর মা ফিসফিস করে আলাপ করছেন। বিরক্তিতে বাবার ভ্রূ কুঁচকে উঠছে ঘন ঘন। অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে বসে থাকছেন। পরশু রাতে মা গুনগুন করে কাঁদছিলেন। আমার কাছে মনে হচ্ছিল, কে যেন ইনিয়েবিনিয়ে গান গাইছে। রাবেয়া বলল, ও খোকা, ও ঘরে মা কাঁদছে রে।
রুনু বলল, সত্যি দাদা, মা কাঁদছে। আমি ভেবেছি–বুঝি বেড়াল।
রাবেয়া গলা উঁচু করে ডাকল, মা, ও মা, কাঁদছ কেন?
মা চুপ করে গেলেন। রাবেয়া আবার ডাকল, মা, ও মা!
মা ধারা— গলায় বললেন, কি?
তুমি কাঁদছিলে কেন?
আমি সমস্ত কিছু বুঝতে চাই। আমি সবাইকে ভালোবাসি। যে-সংসার বাবা গড়ে তুলেছেন, সেখানে আমার যা ভূমিকা, আমি তার চেয়ে অনেক বেশি করতে চাই। যদি কোনো জটিলতা এসেই থাকে, তবে সে-জটিলতা থেকে আমি দূরে থাকতে চাই না। আমি চাই সবাই সুখী হোক। রুনুশীলুর মতো একটি ময়না এনে পুষুক, যেটি সময়ে-অসময়ে মানুষের মতো সুখের শিস দিয়ে উঠবে।
দুপুরবেলা ঘুমিয়ে আছি। হঠাৎ রাবেয়া আমায় ডেকে তুলল। উত্তেজনায় তার চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপছে।
ও খোকা, শুনছ, আমার বিয়ে।
আমি অবাক হয়ে তার দিকে তোকালাম? রাবেয়া খিলখিল করে হেসে বলল, বিশ্বাস হচ্ছে না? আল্লার কসম, সত্যি বিয়ে, আম্মাকে জিজ্ঞেস করে দেখ।
কখন বিয়ে?
আজ বিকেলে। এখন আমি গোসল করে সাজব! তুমি আবার সবাইকে বলে বেড়িও না খোকা, আমার বুঝি লজ্জা নেই?
মাকে জিজ্ঞেস করতেই মা বললেন, বরপক্ষের ওরা বিকেলে দেখতে আসবে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, পাগল মেয়েকে বিয়ে করবে কে?
মা বললেন, পাগল কোথায় রে, ঐ একটু যা আছে তা সেরে যাবে।
বরপক্ষের লোকজন জানে?
মা ভীত কণ্ঠে বললেন, আমি ঠিক বলতে পারি না তোর আরা বলেছে কি না। তুই আপত্তি করিস না খোকা।
কিন্তু হঠাৎ বিয়ের কী হল?
আমি জানি না। তোর আর। শাল ঠিক করেছেন। তোর আরাকে জিজ্ঞেস কর।
দেখতে আসবে পাঁচটায়, চারটার ভিতরেই সব তৈরি হয়ে গেল। মা ঘামতে ঘামতে খাবার তৈরি করলেন। বসবার ঘরে নতুন পর্দা লাগান হল; ট্রাঙ্কে তোলা টেবিল-ক্লথ বিছিয়ে দেয়া হল টেবিলে। মন্টু সাইকেলে করে দূর কোথাও থেকে ফুল এনে ফুলদানি সাজাল। রুনু রাবেয়ার একটি শাপলা রঙের শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। রাবেয়া ঘ্যানঘ্যান করতে লাগল, মা, রুনু যে বড়ো আমার শাড়ি পরেছে, ময়লা করে ফেলবে তো।
ময়লা হলে ইন্ত্রি করিয়ে দেব।
যদি ছিঁড়ে ফেলে?
কি ভ্যাজর ভ্যাজার করছিস।
হুঁ, আমি তো ভ্যাজর ভ্যাজর করছি। আমার যদি আজ বিয়ে না হত, দেখতে রুনুর চুল ছিঁড়ে ফেলতাম না!
রাবেয়া পরেছে বেশ দামী আসমানী রঙের শাড়ি। সাধারণ সাজগোজের বেশি। কিছু করে নি। এতে তাকে যে এত সুন্দরী লাগবে, কে ভেবেছে! বড়ো বড়ো ভাসা চোখ, বরফি-কাটা চিবুক, শিশুর মতো চাউনি। সব মিলিয়ে রূপকথার বইয়ে আকা বন্দী রাজকন্যার ছবি যেন।
মাস্টার কাকা একটা ফর্সা পাঞ্জাবি পরে বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে আছেন, বরপক্ষীয়দের অভ্যর্থনার জন্য। পাঁচটায় তাদের আসার কথা, ছটা পর্যন্ত কেউ এল না। ঠিকানা নিয়ে মাস্টার কাক খুঁজতে গেলেন। জানা গেল কেউ আসবে না। একটি পাগল মেয়ে গছিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র তারা কী করে যেন জেনেছে।
লজ্জায় আমার চোখে পানি এসে পড়ল। কী দরকার ছিল এ সবের? না-ই হত বিয়ে। মা কাঁদো-কাঁদো গলায় বললেন, দরকার ছিল রে।
কী জন্যে?
আমার কেমন যেন সন্দেহ হয় খোকা!
কী সন্দেহ?
কাল তোর বাবা রাবেয়াকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে, তখন জানবি।
বাবা নামলেন রিকসা থেকে। রাবেয়া ধীরে-সুস্থে নামল। মুখ কালো করে বলল, মা, ডাক্তার আমাকে বেশি পরিশ্রম করতে নিষেধ করেছেন। এখন শুধু বিশ্রাম। তাই না বাবা?