কি বই পড়ছিলি দেখি।
রুনু উঁচু করে বই দেখায়। কেঁদে ভাসাবার মতে, কিছু নয়। জীবনে একটি সময় আসে যখন তীব্র অনুভূতিতে সমস্ত আচ্ছান্ন হয়ে থাকে। প্রথম বেতন পেলে রুণুকে একটা চমৎকার শাড়ি কিনে দেব আমি। সবুজ জমিনের উপর সাদা ফুলের নকশা। রোল নাম্বারা থাটিন পর্যন্ত দেখতাম।
অনেক দিন পর শীলুকে দেখলাম। সবাই মিলে চাটগায় গিয়েছিল বেড়াতে। বেশ কিছু দিন পর ফিরল। এত দিন শান্তি কটেজকে কি বিষণ্ণই না লাগছিল। দেখতাম সন্ধ্যা হতেই শান্তি কটেজের বুড়ো দারোয়ান বারান্দায় বাতি জ্বলিয়ে একা একা বসে চুপচাপ। খালি বাড়ি পেয়ে পাড়ার ছেলেমেয়েরা লুকোচুরি খেলতে হাজির হচ্ছে সকাল-বিকাল।
ফুলগাছ নষ্ট করো না গো, ও লক্ষ্মী ছেলেমেয়েরা।
প্রতিবাদের সুরও যেন খালি খাড়ির মতোই বিষন্ন। মাঝে মাঝেই ঝড়ের মতো হাজির হোত রাবেয়া। গেটের বাইরে থেকে তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচাত–এই দারোয়ান এই, এই বুড়ো।
কি খুকি। আপা?
এরা কোথায় গেছে?
বেড়াতে।
কোন বেড়াতে গেল?
দারোয়ান হাসত কথা শুনে। আশ্বাসের ভঙ্গিতে বলত, আবার আসবে আপামণি।
কবে আসবে? কাল?
ষোল তারিখে আসবে।
না, কালকেই আসতে হবে। তুমি ওদের আনতে যাবে ইষ্টিশনে?
জ্বি, আপামণি।
আমিও সঙ্গে যার।
আচ্ছা।
তুমি নিয়ে যাবে তো আমাকে?
জ্বি, আপনাকে নিয়ে যাব, ঠিক যাব। আপামণি।
পেয়ারা পেড়ে দাও আমাকে।
লম্বা আকশি নিয়ে খুশি মনে পেয়ারা খোঁজে বুড়ো। গ্যারেজের উপর ঝাঁকেপড়া গাছে ঝোপে পেয়ারা হয়েছে।
খালি বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আমিও রাবেয়ার মতো আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। কবে আসবে শীলু, যাকে আমি করুণা বলে নিজের মনেই ডাকি। করুণা ছবির মতো দাঁড়িয়ে থাকবে বাগানে, নিজের খেয়ালে গান গেয়ে উঠবে আচমকা। আমাদের বাসার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় ডাকবে, রুনু, রুনু, বাসায় আছ?
এর জন্যে আমি অপেক্ষা করে ছিলাম। ভালোবাসা সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণা নেই। কিন্তু আমি বুকের ভেতর গোপন ভালোবাসা পুষেছি।
কত দিন পর দেখলাম শীলুকে।
গাড়ি থেকে নামতেই আমার সঙ্গে দেখা। খুব কোমল কণ্ঠে বলল, আপনারা সব ভালো ছিলেন তো? রুনু ভালো?
তেমনি লম্বাটে মুখ, কপালের দিকে টানা ভুরু, অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে কথা বলতে-বলতে হঠাৎ থমকে অন্য দিকে তাকাল। আমার হৃৎপিণ্ড দুলে উঠল, শীলুর চোখের দিকে সরাসরি তাকাতে গিয়ে অদ্ভুত কষ্ট হল। আমি বললাম, তোমরা ভালো তো শীলু?
জ্বি।
শীলুর মা মালপত্র নামাতে নামাতে আড়চোখে তাকাচ্ছিলেন আমার দিকে। বুড়ো বয়সেও ঠোঁটে আর মুখে রং মেখেছেন। বয়স অগ্রাহ্য করে পরা চকচকে শাড়িতে তাঁকে হাস্যকর লাগছিল, কিন্তু তবু তিনি শীলুর মা, আমি বিনীত ভঙ্গিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
সবার শেষে নামলেন নাহার ভাবী। ভারি সুন্দর হয়েছেন তিনি। গায়ের মসৃণ চামড়া ঝকঝকি করছে। নাকের উপর জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে। রোদ লোগে। নাহার ভাবী আমাকে দেখে ছেলেমানুষী ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠলেন, আপনাদের কথা যা ভেবেছি।
আমিও ভেবেছি।–আপনারা কবে যে আসবেন!
রুনু আর রাবেয়া কোথায়?
রুনু স্কুলে। রাবেয়া বেড়াতে বের হয়েছে।
রুনুর জন্যে আমি অনেক গল্পের বই এনেছি। অনেক নতুন রেকর্ড কিনেছি।
শীলুর মা ঠাণ্ডা গলায় বললেন, রোদে তোমাদের মাথা ধরবে, ভেতরে গিয়ে বস, মেয়েরা।
শীলু, তোমাকে আমি গোপনে করুণা বলে ডাকি। তোমার জন্যে আমার অনেক কিছু করতে ইচ্ছে হয়। প্রতি রাতে তোমাকে নিয়ে কত কি ভাবি। যেন তোমার কঠিন অসুখ করেছে। শুয়ে শুয়ে দিন গুনছ মৃত্যুর। হঠাৎ এক দিন আমি গিয়ে দাঁড়ালাম তোমার বিছানার পাশে। তুমি ছেলেমানুষের মতো বললে, এত দিন পরে এলেন?
আমি বললাম, তুমি তো আমায় কখনো ডাক নি শীলু। ডাকলেই আসতাম। তুমি বিবৰ্ণ ঠোঁটে হাসলে। আমি বসলাম তোমার পাশে। জানালা দিয়ে হুঁহু করে হাওয়া আসছে। হাওয়ায় কাঁপছে তোমার লালচে চুল। আমি তোমার মাথায় হাত রাখলাম। তুমি বললে জানেন আমার যে একটি ময়না ছিল। সেটি ঠিক মানুষের মতো শিস দিত, খাঁচা ভেঙে পালিয়েছে।
কী হাস্যকর ছেলেমানুষী ভাবনা! কত দিন ভাবতে-ভাবতে রাত হয়ে যেত। রাস্তায় নিশি-পাওয়া কুকুর চেঁচাত। ঘুম ভেঙে মাস্টার কাকা উঠে আপন মনে কথা বলতেন।
আমার বন্ধু রমিজ এক বিবাহিতা ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করেছিল। মেয়েটি তার স্বামী ও দুটি বাচ্চা ছেলে-মেয়ে ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল রমিজের সঙ্গে। ভদ্রমহিলার স্বামী দুঃখে লজ্জায় এন্ড্রিন খেয়ে মরেছিল। ঘটনাটি শুনে রমিজের প্রতি আমার প্রচণ্ড ঘৃণা হয়েছিল। এর অনেক দিন পর যখন শীলুরা ঘর অন্ধকার করে বাইরে বেড়াতে গেল, তখন কেন যেন মনে হল।রামিজ কোনো দোষ করে নি।
ভালোবাসার উৎস কী আনি জানি না। আশফাক বলত, ভালোবাসা হচ্ছে নিছক কামনা, যৌন আকর্ষণের পরিভাষা। কিন্তু আমার তা মনে হয় না। আমার গলা জড়িয়ে শীলু কখনো ঘুমিয়ে থাকবে।–এ ধরনের কল্পনা তো কখনো মনে আসে না।
একদিন শীলুর বয়স হবে। পাক ধরবে তার চুলে, পোকায় কাটা অশক্ত দাঁতে কালো ছোপ পড়বে, ছানি-পড়া চোখের ঝাপসা দৃষ্টিতে তখন কি সে দেখতে পারবে বছর ত্ৰিশোক আগে একটি অনুভূতিপ্রবণ তরুণ ছেলে কান পেতে আছে কখন সেই কোমল কণ্ঠ শোনা যাবে, দাদু ভাই, রুনু বাসায় আছে?
আমি ইদানীং কেমন আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছি। মা আমাকে মাঝে মাঝে বুঝতে চেষ্ট করেন। রুনু প্রায়ই অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। হয়তো আমার বোঝার ভুল। তবু তার হাবভাব যেন কেমন। যেন কিছু জানতে চেষ্ট করছে। সেদিন অপ্রাসঙ্গিকভাবেই বলে বসল, শীলুকে কি তোমার খুব বুদ্ধিমান বলে মনে হয়, দাদা ভাই?