কোথায়?
যেখানে ওরা আপনার জায়গা করেছে। রুম নাম্বার সিক্স। আমি ওদের টেলিফোন করেছিলাম।
ও।
আপনি দেশে একটা টেলিগ্রাম করে দিন যে ঠিকমত পৌঁছেছেন। ওরা সবাই নিশ্চয়ই খুব চিন্তিত হয়ে অপেক্ষা করছে। বাসায় টেলিফোন থাকলে টেলিফোন করা যেতে পারে।
টেলিফোন নেই।
পাশের কোনো বাসায় আছে, যারা ডেকে দেবে?
জজ সাহেবের বাসায় আছে, কিন্তু ওদের নাম্বার জানি না।
তাহলে টেলিগ্রামই করা যাক। ঠিকানা বলুন।
রেবেকা ঠিকানা বলল।
বলুন কী লিখব?
রিচড সেফলি।
পাশা হাসিমুখে বলল, আপনার এই টেলিগ্রাম আপনার সব আত্মীয়স্বজন পড়বে। কাজেই আরো দুটি লাইন যোগ করে দিই? ওদের ভালো লাগবে।
রেবেকা কিছুই বলল না। পাশা বলল, আমি লিখলাম–নিরাপদে পৌছেছি। তোমাদের সবার জন্য খুব মন খারাপ লাগছে। এত সুন্দর দেশ, কিন্তু মোটও ভালো লাগছে না।
রেবেকা তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। তার চোখ ভিজে উঠছে। পাশা বলল, পাঠাব এ টেলিগ্রাম?
হ্যাঁ, পাঠান।
আপনার এই মন-খারাপ ভাব দু-এক দিনের মধ্যেই কেটে যাবে। যখন পড়াশোনা শুরু হবে, তখন দেখবেন দম ফেলার সুযোগ পাচ্ছেন না। এবং দেখতে দেখতে দেশে ফেরার দিন এসে যাবে। কী আনন্দ হবে, চিন্তা করে দেখুন।
রেবেকা লক্ষ করল, তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। পাশা নরম গলায় বলল, বিদেশ থেকে দেশে ফেরার আনন্দ ভোগ করবার জন্যেই সবার কিছু দিন বিদেশে থাকা উচিত। ফেরার সময় সবাই একটা নেশার ঘরে থাকে। যাই দেখে তাই কিনে ফেলতে চায়। আমি আমার এক বন্ধুকে দেখেছি, সে তাদের বাড়ির কাজের ছেলেটির জন্যে পঁয়ত্রিশ ডলার দিয়ে একটা ডিজিট্যাল ঘড়ি কিনল। অথচ সেই ছেলেটিকে সে কোনো দিন দেখেও নি। চিঠিপত্রে এক-আধ বার তার নাম এসেছে।
রেবেকার চোখ পানিতে ভরে উঠেছে। সে উঠে দাঁড়াল। বাথরুমে গিয়ে সে খানিকক্ষণ কাঁদবে।
পাশা মেয়েটির প্রসঙ্গে বেশ কিছু ব্যাপার লক্ষ করল–এই মেয়ে এক বারও আপনাকে ধন্যবাদ, এই কথাটি বলে নি। এক জন মানুষ রাতদুপুরে তাকে নিয়ে এসেছে, সব রকম ঝামেলা মেটাবার চেষ্টা করছে–এই দিকটি যেন তার চোখেও পড়ছে না। যেন সমস্ত ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক, এরকমই হওয়া উচিত। এর কারণ কী?
একটিমাত্র কারণ–হয়ত এই মেয়ে নিজের পরিবারের বাইরে কারো সঙ্গে তেমন মেশে নি। পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে যে-ব্যবহার সে পেয়ে এসেছে তাতেই সে অভ্যস্ত। বাইরের একটি মানুষ এরকমই ব্যবহার করবে বলে তার ধারণা। তাছাড়া দেশের বাইরে নিজের দেশের মানুষদের সব সময়ই খুব আপন মনে হয়। ওদের কাছ থেকে আত্মীয়দের মতো ব্যবহার চোখে পড়ে না। সেটাই তো স্বাভাবিক।
ফুড টেকনলজির শর্ট কোর্স
সোমবার ভোর নটায় ডক্টর ওয়ারডিংটন, ফুড টেকনলজির শর্ট কোর্স উদ্বোধন করলেন। সব মিলিয়ে পঁয়ত্রিশ জন ছাত্র। অর্ধেকের বেশি হচ্ছে বিদেশী। মেয়েদের সংখ্যা সাত। তাদের মধ্যে তিন জন বিদেশী। রেবেকা, শ্রীলঙ্কার আরিয়ে রত্ন এবং রেড চায়নার মি ইন। মি ইন খুব সিরিয়াস। ড. ওয়ারডিংটনের উদ্বোধনী বক্তৃতাও সে নোট করতে লাগল।
ড. ওয়ারডিংটন প্রথমে কী-একটা রসিকতা করলেন। রেবেকা সেই রসিকতাটি বুঝতে পারল না। কিন্তু আমেরিকান ছাত্রছাত্রীরা খুব মাথা দুলিয়ে হাসতে লাগল। রেবেকার প্রথমে মনে হল, একমাত্র সেই বুঝতে পারে নি। তারপর লক্ষ করল বিদেশীদের সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। তার পাশে বসে আছে। শ্রীলঙ্কার আরিয়ে রত্ন। সে বিরক্ত মুখে বলল, কী বলছে? রেবেকা মাথা নাড়ল, সে জানে না।
কোর্স কোঅর্ডিনেটরের মূল বক্তৃতা বুঝতে কারো কোনো অসুবিধা হল না। তিনি সম্ভবত বিদেশীদের জন্যেই প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট করে উচ্চারণের চেষ্টা করছিলেন এবং পারছিলেন। কোর্সটি ছোট। কিন্তু ছোট হলেও এটা এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে, কোর্স শেষ হবার পর সবাই ফুড টেকনলজির বেসিক্সগুলি খুব ভালোমত জানবে। প্রথম পাঁচ সপ্তাহ আমরা তিনটি কোর্স দেব। কেমিস্ত্রি, রেডিয়েশন কেমিষ্ট্রি এবং মাইক্রোবায়োলজি। পরের তিন সপ্তাহ প্র্যাকটিকেল ট্রেনিং হবে মেনিয়াপোলিসে ফুড প্রসেসিং-এর কারখানায়। বাকি থাকল চার সপ্তাহ। সেই চার সপ্তাহে সবাইকে একটি করে স্পেশাল টপিকে পেপার করা হবে। টপিকগুলি এখনি দিয়ে দেওয়া হবে। তোমরা তোমাদের পছন্দমত টপিক নিতে পার।
এই পর্যায়ে ড. ওয়ারডিংটন আরেকটি রসিকতা করলেন। আমেরিকানগুলি গলা ছেড়ে হাসতে লাগল। আরিয়ে রা বিরক্ত মুখে ফিসফিস করে বলল, ব্যাটা বলছে কী? মি ইনও অস্বস্তির সঙ্গে তাকাচ্ছে। শুধু জর্ডনের আবদুল্লাহ পেটে হাত দিয়ে ঠা-ঠা করে আসছে। বিদেশী ছেলেদের মধ্যে এই এক জনের নামই সে মনে রেখেছে। সে অবশ্যি নিজের নাম আবদুল্লাহ বলে নি, বলেছে–আবাড়ুল্লা।
ড. ওয়ারডিংটন বললেন, এখন আমরা স্পেশাল টপিকগুলি ভাগ করে দেব। তারপর পঁচিশ মিনিটের কফি-ব্রেক আছে। কফি-ব্রেকের পরপরই থিওরি ক্লাস শুরু হবে। থিওরি ক্লাসে দু রকমের পরীক্ষা হবে। একটা হচ্ছে ক্লাস শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে কুইজ। অন্যটি কোর্স শেষ হবার পর। ফাইনাল গ্রেডিং হবে দুটি মিলিয়ে। ওয়েটেজ হচ্ছে ফিফটি-ফিফটি।
আরিয়ে রত্না চোখ কপালে তুলে বলল, পরীক্ষা হবে নাকি? কী সর্বনাশ! আমি তো পরীক্ষার জন্য তৈরী না।
রেবেকা বলল, এখন হবে না। পড়াবার পর হবে।