তারা কত বার বলেছে, শুধু টাকা পাঠান কেন দুলাভাই, এটা-সেটা কিনে পাঠাবেন।
কী কিনব বল? কিছুই মনে ধরে না।
আপনার মনে ধরার দরকার কি? আপাকে সঙ্গে নিয়ে কিলবেন।
আচ্ছা, পরের বার থেকে তাই করব।
দুলাভাই লোকটা বোকাসোকা ধরনের। থলথলে মোটা, বিয়ের এক বছরের মধ্যে বেশ উঁচু একটা ভুড়ি বাগিয়ে ফেললেন। সেই ভুড়ি নিয়ে খালিগায়ে শস্ত্রবাড়ির রান্নাঘরে শাশুড়ির পাশে বসে মাছ কাটা দেখেন, তালপাতার হাওয়া খেতে খেতে সস্তা ধরনের রসিকতা করেন। সেই রসিকতা শুনে মা হেসে বাচেন না। আপা কত বার বলে, খালিগায়ে তুমি বাবা-মার সামনে ওভাবে চলাফেরা কর, ছিঃ ছিঃ।
কী করব বল, গরম লাগে।
গরম লাগে, ফ্যানের নিচে বসে থাক। রান্নাঘরে বসে আছ কেন?
গল্পগুজব করবার জন্যে বসি। রাগ কর কেন?
বাবুকে কোলে নিয়ে বসার ঘরে গিয়ে খানিকক্ষণ বস তো, প্লীজ।
আচ্ছা বাবা আচ্ছা, যাচ্ছি। লেবুর সরবত বানিয়ে পাঠাও তো। গরমটা কাবু করে ফেলছে।
এখন লেবুর সরবত বানান যাবে না। লেবু নেই ঘরে।
মা সঙ্গে সঙ্গে টুটুলকে পাঠাবেন লেবু কিনতে। দুলাভাইয়ের মুখের কথা এ বাড়িতে অমোঘ আদেশ। বাবা-মা দুজনেই দুলাভাইকে জিজ্ঞেস না-করে কিছু করতে পারেন না। ফরিদা সায়েন্স পড়বে না আর্টস পড়বে? দুলাভাইয়ের কাছে। চিঠি গেল। তিনি যা বলবেন তাই। টুটুল সাইকেল কিনবে। বাবা কিছুতেই দেবেন। না। তার ধারণা, সাইকেল নিয়ে রাস্তায় বেরলেই এ্যাক্সিডেন্ট হবে। টুটুল কুমিল্লায় গিয়ে দুলাভাইকে ধরল। তিনি চিঠি লিখে দিলেন। টুটুল সাইকেল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে প্রথম দিনই ঠেলাগাড়ির সঙ্গে এ্যাক্সিডেন্ট করে হাত ভেঙে ঘরে এল। বাবামা কেউ দুলাভাইয়ের বিরুদ্ধে একটি কথাও বললেন না।
রেবেকার মনে ক্ষীণ ভয় ছিল, দুলাভাই হয়তো বলে বসবেন, মেয়েমানুষ একা-একা এত দূর যাবে কি? আমেরিকা জায়গাটাও মেয়েদের জন্যে তেমন সুবিধে না। তাহলেই সৰ্বনাশ হত। ভাগ্যিস দুলাভাই কিছু বলেন নি। মানিঅর্ডার পাবার দু দিন পর তার উপদেশ-ভর্তি দীর্ঘ চিঠি এসে পড়ল। পুনশ্চতে লেখা–ইটের ভাটায় আগুন দেওয়া হবে বলে এখন আসতে পারছি না, তোমার রওনা হবার দিন সাতেক আগে আসব।
বাবা-মা তাতে রাজি হলেন না। টুটুলকে পাঠিয়ে দিলেন নিয়ে আসবার জন্যে। টুটুল নিয়ে এল।
দুলাভাই ঘরে ঢুকে প্রথম যে-কথাটা বললেন, সেটা হচ্ছে–একটা ভালো ছেলে আছে আমার হাতে, ঠিকানা নিয়ে এসেছি। বাবা-মা যেন এই কথাটা শোনবার জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। তাঁরা প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। টুটুল বিকট স্বরে চেঁচাতে লাগল, ছোটআপার বিয়ে, ছোটআপার বিয়ে।
দুলাভাই ম্যাজিশিয়ানের ভঙ্গিতে ছেলের ছবি বের করলেন। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল ছবির উপর। টানাটানি করতে গিয়ে ছবির কোণা ছিঁড়ে গেল। স্টুডিওতে তোলা বোকা-বোকা ধরনের চেহারার একটা মানুষ। একুশ তারিখে যার আমেরিকা যাত্রা, তার বিয়ে হয়ে গেল তের তারিখে সেই বিয়েও অদ্ভুত। ছেলে তার মামা আর ছোটচাচাকে নিয়ে মেয়ে দেখতে এসেছে। ছেলের বাবা আসতে পারেন নি, অসুস্থ।
মেয়ে দেখে তাদের পছন্দ হল। ছেলের মামা বললেন, এক জন মৌলবী ডেকে নিয়ে আসুন, বিয়ে পড়িয়ে দেওয়া যাক। আমি ছেলের বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এসেছি। মেয়ে যখন চলে যাচ্ছে, সময়ও তো নেই হাতে, কী বলেন?
বড়ো দুলাভাই সঙ্গে সঙ্গে কাজী খুঁজতে বের হয়ে গেলেন। রাত এগারটার সময় বিয়ে পড়ান হয়ে গেল।
পাশের ঘরে খুটখুট শব্দ হচ্ছে। রেবেকা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে দরজা খুলে বের হল। যেমানুষটি কাল রাতে তাকে নিয়ে এসেছে সে এগিয়ে এসে বলল, ঘুম ভালো হয়েছে?
ভালো। অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছি?
না, বেশিক্ষণ না। ঘন্টা তিনেক। এখন মাত্র আটটা বাজে।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, লম্বা ঘুম দিয়েছি।
বড়ো রকমের জানির পর এ-রকম হয়। ঘন্টাখানেক ঘুমালেই মনে হয় অনেকক্ষণ ঘুমান হল। কিছুক্ষণ পর আবার ঘুম পায়। খিদে হয়েছে? ব্রেকফাস্ট তৈরি করি?
এই লোকটিকে এখন অন্য রকম মনে হচ্ছে। এ যেন অন্য লোক। রাতে তালগাছের মতো লম্বা লাগছিল। এখন লাগছে না। যতটা বয়স্ক মনে হচ্ছিল, ততটা বয়স্ক মনে হচ্ছে না। ছোটমামার চেহারার সঙ্গেও এর কোন মিল নেই।
ব্রেকফাস্ট খুব সুবিধের হবে না। ঘরে কিছু ছিল না। আমি নিজে ভোরবেলায় কিছু খাই না, তাই কিছু রাখা হয় না। আসুন, টেবিলে আসুন।
রেবেকা অবাক হয়ে তাকাল। এই লোকটি এখন তাকে আপনি-আপনি করে বলছে কেন?
রেবেকা, আমি আপনার ডরমিটরিতে ফোন করেছিলাম। আপনার সব ব্যবস্থা করা আছে ওখানে। নাশতা খাবার পর আপনাকে দিয়ে আসব। আপনি চা খাবেন, না কফি? এখানে ভালো চা পাওয়া যায় না। কফি খুব ভালো। ব্রাজিলের কফিনিস থেকে তৈরী।
আমি চা খাব।
রেবেকা খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, কাল রাতে আপনি আমাকে তুমিতুমি করে বলছিলেন। এখন আপনি-আপনি করছেন কেন?
রাতে তুমি-তুমি করে বলছিলাম বুঝি? কেন, আপনার মনে নেই?
না। মনে নেই।
এ বাড়িতে আপনি একাই থাকেন?
হ্যাঁ, একা থাকি। কিছু দিন আমার এক বন্ধু ছিল–ফরিদ। এখন একা।
রেবেকা অন্যমনস্ক হয়ে গেল। এই লোকটিকে এত চেনা-চেনা লাগছে কেন? খুব পরিচিত কারো চেহারার সঙ্গে এর মিল আছে। কিন্তু কার চেহারা?
আমি এয়ারলাইনস-এ টেলিফোন করেছিলাম, ওরা আপনার সুটকেস ট্রেস করেছে। দশটায় যেতে বলেছে। সেখান থেকে আমরা সুটকেস নেব, তারপর আপনাকে রেখে আসব ডরমিটরিতে।