রেবেকার জেগে থাকতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু জেগে থাকতে পারছে না। বারবার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। ভদ্রলোক সিগারেট ধরিয়েছেন। গাড়ির কাঁচ ওঠান। সিগারেটের ধোঁয়ায় বমি এসে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে নিশ্চয়ই বলা যাবে না–সিগারেট ফেলে দিন। নাসিমেরও এ রকম অভ্যাস। ঠিক ঘুমাতে যাবার আগে মশারির ভেতর ঢুকে একটা সিগারেট টানবে। সেই কড়া গন্ধ মশারির ভেতর আটকে থাকবে সারা রাত। অভ্যাসটা প্রায় কাটিয়ে এনেছিল, এখন সে নিশ্চয়ই আবার শুরু করবে এবং এক দিন বিছানায় আগুনাগুন লাগিয়ে একটা কাণ্ড করবে। রেবেকা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
রেবেকা বুঝতেই পারল না
চোখ মেলে রেবেকা বুঝতেই পারল না সে কোথায়। তার চারদিকে অপরিচিত গন্ধ। অপরিচিত অদ্ভুত শব্দ। সে কি তার নানার বাড়িতে? যে-কোন অচেনা জায়গায় ঘুম ভাঙলেই প্রথম যে-জিনিসটি তার মনে আসে, সেটা হচ্ছে–এটা কি নানার বাড়ি? ব্রহ্মপুত্রের উড়ে-আসা হওয়ায়-ভর্তি একটি প্রাচীন কোঠায় তার ঘুম ভাঙলঃ বিছানার চাদরটি কপূরের গন্ধমাখা, পায়ের কাছে বিশাল কোলবালিশ। রেলিং দেওয়া ঘন কালো রঙের খাটটাকে সব সময়ই মনে হত সমুদ্রের মতো বিশাল।
এটা নানার বাড়ি নয়। এর সব কিছুই অদ্ভুত। হোস করে একটা শব্দ হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে শো-শোঁ আওয়াজ। আবার খানিকক্ষণ নিস্তব্ধতা। আবার হোস করে শব্দ।
রেবেকা উঠেবসল। মাঝারি ধরনের একটা ঘর। দুদিকের দেয়াল জুড়ে পর্দাঢাকা বিশাল কাঁচের জানালা। পর্দার রঙ হালকা সবুজ। ঘরের দেয়ালের রঙ ধবধবে সাদা, যেন কিছুক্ষণ আগে কেউ এসে চুনকাম করে গিয়েছে। মেঝেতে গাঢ় সবুজ রঙের শ্যাগ কাৰ্পেট। নতুন দূর্বাঘাসের মতো কোমল। পা রাখতে মায়া লাগে। ঘরে আসবাবপত্র তেমন কিছু নেই। এক পাশে ছোট্ট একটা লেখার টেবিল টেবিলের ওপর অদ্ভুত ডিজাইনের একটি টেবিলল্যাম্প। এত সুন্দর হয় মানুষের ঘর: রেবেকা উঠে গিয়ে জানালার পর্দা সরাল। যত দূর চোখ যায়–বরফ-সাদা প্রান্তর। বা পাশে পুতুলের বাড়ির মত এক সারি বাড়ি। হঠাৎ করে স্বপদৃশ্যের মতো লাগে। স্বপ্নের সব সুন্দর ছবিই মন খারাপ করে দেয়। এটিও দিচ্ছে। মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে রেবেকার, কান্না পেয়ে যাচ্ছে। সে তাহলে আমেরিকায় এসে পড়েছে? তার চোখের সামনে আমেরিকা?
বাসায় যেদিন খবর নিয়ে এল সে তিন মাসের ট্রেনিং-এ যাচ্ছে, কেউ প্রথমে বিশ্বাস করল না। বাবা বললেন, সত্যি-সত্যি কোনো চান্স আছে? রেবেকা বলল, আমি একুশ তারিখ যাচ্ছি। চিঠি পড়ে দেখা বাবা সেই চিঠি প্রায় দশ বার পড়লেন এবং হঠাৎ এমন উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। উত্তেজনায় তার মাথা ধরে গেল, তিনি দুই হাতে কপালের রগ টিপে ধরে গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। মা অবাক হয়ে বললেন, কী লিখেছে চিঠিতে? রেবা সত্যি যাচ্ছে? পড় না শুনি।
বাবা বললেন, একুশ তারিখ রওনা হতে হবে।
কোন মাসের একুশ তারিখ?
এই মাসের। আবার কোন মাসের?
কী উত্তেজনা চারদিকে। মা গুটিসুটি অক্ষরে তার সমস্ত আত্মীয়স্বজনকে চিঠি লিখলেন–র সংবাদ এই যে, রেবা স্কলারশিপ লইয়া আমেরিকা যাইতেছে। তাহার যাত্রার দিন ধার্য হইয়াছে এই মাসের একুশ তারিখ। সে ইতিমধ্যেই তিসার
জন্য গিয়াছে। ভিসার জন্য চার তারিখে ইন্টারভিউ হইবে। তবে স্কলারশিপ আমেরিকা সরকারের, কাজেই ভিসা পাওয়া ইনশা আল্লাহ্ কোনো সমস্যা হইবে না।…
রেবেকা এক দিনেই বাসার অন্য সবার চেয়ে আলাদা হয়ে গেল। সবাই সমীহ করে কথা বলে। সামনের বাসার জজ সাহেব পর্যন্ত এক দিন রাস্তায় দাঁড় করিয়ে অনেক গল্প করলেন।
শুনলাম, আমেরিকা যাচ্ছ?
জ্বি-চাচা।
গুড, ভেরি গুড। কোন স্টেট?
নর্থ ডাকোটা।
নর্থ ডাকোটায় যাই নি কখনো। সাউথ ডাকোটায় গিয়েছিলাম। মাউন্ট রাশমূর দেখতে। চার প্রেসিডেন্টের মূর্তি আছে পাহাড়ের গায়ে–পাথর কেটে করা। মূর্তির নাকই হল গিয়ে তোমার আট মিটার। যাচ্ছ কবে?
একুশ তারিখে।
কোন এয়ারলাইনস?
তা এখনো জানি না চাচা। টিকেট হয় নি এখনো।
ভালো ভালো। খুব খুশির সংবাদ।
তাঁর মুখ দেখে অবশ্যি মনে হয় না তিনি খুশি হয়েছেন, কিন্তু মার মুখ দেখে। যে-কেউ বলে দিতে পারে, বড়ো একটা সুখের ঘটনা ঘটেছে তাঁর জীবনে। এই ঘটনাটা পরিচিত অপরিচিত কাউকে জানাতেও তিনি কখনো দেরি করেন না। এত আচমকা এই প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন যে রীতিমতো লজ্জা লাগে। হয়তো দোকানে কিছু একটা কিনতে গিয়েছে রেবেকা, সঙ্গে মা আছেন। জিনিসটি পছন্দ হয়েছে, এখন কেনা হবে। মা বলে বসবেন, খামাখা এত দাম দিয়ে এটা কেনার কোনো মানে হয়? ছ দিন পর আমেরিকা যাচ্ছি। সেখানে কিনে নিবি, সস্তায় পাবি।
রেবেকা বুঝতে পারে, মা মনে-মনে অপেক্ষা করেন–দোকানী বলবে, আমেরিকা যাচ্ছে বুঝি? কবে? বেশির ভাগ দোকানী কোনো রকম আগ্ৰহ দেখায় না। দু-এক জন অবশ্যি জিজ্ঞেস করে। তাদের দোকান থেকে মা কিছু-না-কিছু। কিলবেনই। যাবার সময় হাসিমুখে বলবেন, আচ্ছা, তাহলে যাই রে ভাই।
কী উত্তেজনার দিনই না গিয়েছে। কুমিল্লা থেকে বড় দুলাভাই তার নামে এক হাজার টাকা মানিঅৰ্ডার করে পাঠিয়ে দিলেন। কুপনে লেখা–বিদেশ যাবার আগে যদি টুকিটাকি কিছু কেনার দরকার হয় সেই জন্যে। টাকা পাঠানটা দুলাভাইয়ের নতুন ব্যাপার নয়। কোনো একটা কিছু হলেই দুলাভাইয়ের কাছ থেকে টাকা চলে আসবে। টুটুল ক্লাস সিক্সে বৃত্তি পেল। দুলাভাই এক শ টাকা পাঠালেন। ফরিদা একটা লেটার পেয়ে ফাস্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাস করল, দুলাভাইয়ের মানিঅৰ্ডার চলে এল।