কিন্তু শেষ পর্যন্ত জনসন নামের তালগাছের মতো লম্বা কালে ছেলেটি তাকে নিয়ে গেল একটি নাম্বার ইলেভেনে। বোর্ডিং কার্ড করিয়ে দিয়ে কোমল স্বরে বলল, এগার নম্বর দেখে দেখে চলে যাও। আর কোনো প্রবলেম হবার কথা নয়।
থ্যাংকস দিতে গিয়ে রেবেকার গলা জড়িয়ে গেল। ছেলেটি বলল, টেক কেয়ার অব ইয়োরসেলফ। এই বলেই সে তার বিশাল হাত বাড়িয়ে দিল। হাত বাড়ান হয়েছে হ্যাগুশেকের জন্য, এটা বুঝতে অনেক সময় লাগল রেবেকার।
অনেকক্ষণ রেবেকার হাত ঝাকাল ছেলেটি। কিংবা হয়তো অল্পক্ষণই ঝাঁকিয়েছে–রেবেকার মনে হয়েছে অনন্তকাল। কী বিশাল হাত। কিন্তু কেমন মেয়েদের মধ্যে তুলতুলে। ছেলেটি আবার বলল, টেক কেয়ার অব ইয়োরসেলফ।
লম্বা-লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে ছেলেটি। কোনো দিনই আর তার সঙ্গে দেখা হবে না।
এন ডাবলিউ টুটু ওয়ান আকাশে উড়তে শুরু করেছে। এক নিরুদ্দেশ থেকে অন্য এক নিরুদ্দেশের দিকে যাত্রা। বুকের মধ্যে দলা পাকিয়ে কান্না উঠে আসছে। শুধুই বাড়ির কথা মনে পড়ছে।
এক দঙ্গল মানুষ এসেছিল এয়ারপোর্টে, সবাই এমন কান্নাকাটি শুরু করল, যেন তাদের এই মেয়ে কোনো দিন দেশে ফিরে আসবে না। বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, কী শুরু করলে তোমরা? তিন মাসের জন্য যাচ্ছে, আর সবাই মরাকান্না শুরু করলে? কোনো মানে হয়? বলেই নিজেই চোখ মুছতে শুরু করলেন।
বড় দুলাভাই বললেন, ওকে নাসিমের সঙ্গে একা থাকতে দাও না, তোমরা সবাই একটু এদিকে আস তো নাসিম অনেকটা দূরে একা-একা দাঁড়িয়ে ছিল। বড় দুলাভাই তাকে পাঠিয়ে দিলেন। সে বিয়ের পাঞ্জাবিটা পরে এসেছে। পাঞ্জাবি মাপমতো হয় নি, বেশ খানিকটা লম্বা হয়েছে। সেই লম্বা পাঞ্জাবিতেই এত সুন্দর লাগছে তাকো নাসিম লাজুক ভঙ্গিতে কাছে এসে দাঁড়াল। সবাই তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। এইভাবে কোন কথা বলা যায়? কিন্তু কী প্রচণ্ড ইচ্ছাই না করছিল কথা বলতে। রেবেকা শেষ পর্যন্ত বলল, এই পাঞ্জাবিটা পরতে না করলাম, তার পরও কেন পরলে?
সে কোন কথা বলল না। লাজুক ভঙ্গিতে হাসল। রেবেকা থেমে-থেমে। বলল, আজ রাতেই তুমি কিন্তু আমাকে চিঠি লিখবে।
হ্যাঁ লিখব। আজ রাতেই লিখব।
এত লোকজন তার চার পাশে, তবু সবাইকে ছাড়িয়ে সাত দিন আগের পরিচিত এই মানুষটিই কেন প্রধান হয়ে উঠলঃ সাত দিন আগে তো সে কোন দিন একে দেখে নি। রাতের বেলা যেসমস্ত কল্পনার মানুষদের সঙ্গে সে কথাবার্তা বলত, এদের কারো সঙ্গেই এই লোকটির কোন মিল নেই। তার চেহারা সাধারণ। কথাবার্তা সাধারণ। পোশাকআশাকও সাধারণ। তবু কেন মনে হচ্ছে সুদূর কৈশোরে যাকে সে ভেবেছে– সে-ই, অন্য কেউ নয়, দীর্ঘ দিনের চেনা এক জন?
রেবেকা গাঢ় স্বরে বলল, যাই। নাসিম হাসল।
আশেপাশে কেউ না থাকলে নিশ্চয়ই সে এগিয়ে এসে হাত ধরত। বেচারা বডড লাজুক। কিসের এত লজ্জা মা, বাবা, ভাই, বোন যদি সবার সামনে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারে, সে কেন সামান্য হাতটা ধরতে পারবে না? এত জঘন্য কেন আমাদের দেশ?
কাঁদবে-না কাঁদবে-না ভেবেও রেবেকা কেঁদে ফেলল। নাসিম বলল, ছিঃ ছিঃ, কী করছ? দুদিন পর তো এসেই পড়বে।
রেবেকা ধরা গলায় বলল, তোমাকে এত বক্তৃতা দিতে হবে না। চুপ করে থাক।
রেবেকার পাশের সীটের মহিলাটি পাখির মত গলায় বলল, আমেরিকায় এই প্রথম আসছ?
হ্যাঁ।
খুব হোমসিক ফিল করছ, তাই না?
হ্যাঁ।
হোমসিকনেস থাকবে না, কেটে যাবে। এ দেশে এসে কেউ হোমসিক হয়। না।
আত্মতৃপ্তির হাসি আমেরিকানটির মুখে। সে স্বৰ্গরাজ্যের সন্ধান দিচ্ছে।
কিন্তু এই স্বৰ্গরাজ্যে যেতে ইচ্ছে করছে না। এ রকম যদি হত যে এটা একটা স্বপ্ন। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাবে এবং রেবেকা দেখবে যে তার পরিচিত বিছানায় শুয়ে আছে। ঝুমঝুম করে বৃষ্টি পড়ছে টিনের চালে। বৃষ্টির ছাটে তার বিছানা ভিজে গেছে। কিন্তু তা হবে না। এটা স্বপ্ন নয়। এটা সত্যি।
এয়ারহোস্টেস এসে রাতের খাবার দিয়ে গেল। প্রতিটি জিনিসই দেখতে এত সুন্দর, কিন্তু খেতে এত জঘন্য। বমি এসে যায়।
তোমার কি কোনো ডিংক লাগবে?
না।
ভালো শেরী আছে, পর্তুগালের।
না, আমার লাগবে না। আর আমি এসব কিছুই খাব না। নিয়ে যাও।
তুমি কি অসুস্থ?
না। আমি ভালেই আছি।
রেবেকা জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। অনেক উঁচুতে প্লেন। নিচের কিছুই দেখা যায় না। ঘঘালাটে একটি চাদরে পৃথিবী ঢাকা।
এত কুৎসিত, এত কুৎসিত।
পাশা লাউঞ্জের এক প্রান্তে
পাশা লাউঞ্জের এক প্রান্তে ঘুমিয়ে-থাকা মেয়েটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। অবাক হবার মূল কারণ মেয়েটির সৌন্দর্য নয়। চেহারা সাধারণ বাঙালী মেয়েদের মত। শ্যামলা রঙ, বৃত্তাকার মুখ। চাপা নাক। এশীয় মেয়েদের মধ্যে অপুষ্টিজনিত কারণে যে-কোমল ভাব থাকে, তা অবশ্যি আছে।
পাশা অবাক হয়েছে, কারণ মেয়েটির গায়ে আসমানী রঙের শাড়ি আর সোয়েটারটির রঙ লাল। মাথায় জড়ান মাফলারটি ধবধবে সাদা রঙের। যা কল্পনা করা হয়েছিল, তাই।
কাকতালীয় যোগাযোগ, বলাই বাহুল্য। হঠাৎ করে মিলে যাওয়া। তবু কিছুটা কি রহস্যময় নয়? কল্পনার সঙ্গে বাস্তব এতটা কি কখনো মেলে? প্রবাবিলিটি অবশ্যি সব কিছুরই থাকে। তবু সেই প্রবাবিলিটি কি খুব কম নয়?
পাশা নিঃশব্দে মেয়েটির চেয়ারের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। বেচারি আমেরিকা আসার উত্তেজনায় নিশ্চয়ই ক রাত ঘুমাতে পারে নি। প্লেনে ঘুমানর প্রশ্নই ওঠে না। এখানে তাই ঘুমে চোখ জড়িয়ে এসেছে। কেমন অসহায় লাগছে। মেয়েটিকে। এত কমবয়সী একটি মেয়ে একা-একা চলে এসেছে এত দূর? আশ্চর্য তো! ঘুমাক খানিকক্ষণ। এই ফাঁকে আরেক কাপ কফি খাওয়া যেতে পারে। পাশা ভেণ্ডিং মেশিনের দিকে এগিয়ে গেল।