পাশা বিড়বিড় করতে লাগল। সব কিছু তার কাছে কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। দু পাশে বিস্তীর্ণ মাঠ। বরফে ঢেকে আছে চারদিক। আকাশ ঝলমল করছে। অসংখ্য তারা আকাশে। নক্ষত্রের আলোয় বরফঢাকা প্রান্তর আলো হয়ে আছে। এই আলো মানুষের মনে শূন্যতাবোধ এনে দেয়। ভয় পাইয়ে দেয়।
পাশার গাড়ির বেগ বাড়তেই থাকল। পুরনো গাড়ি। ঝুমঝুম শব্দ হচ্ছে। হাইওয়ে পেট্রলের কেউ এসে এক্ষুণি হয়তো আলো ফেলবে তার সাইড মিররে। গাড়ি থেকে নামিয়ে বুঝতে চেষ্টা করবে–এই লোকটি মদ খেয়ে গাড়ি চালাচ্ছে কি-না। তারপর ঠাণ্ডা গলায় বলবে, তুমি কত মাইল বেগে গাড়ি চালাচ্ছ, তা কি জান?
জানি।
কেন চালাচ্ছ?
সে হেসে বলবে, নক্ষত্রের রাতে সব কেমন এলোমললা হয়ে যায় অফিসার।
অফিসার তাকাবে তীক্ষ চোখে। আমেরিকানরা হেঁয়ালি ধরনের কথাবার্তা পছন্দ করে না।
হেক্টর এয়ারপোর্ট
হেক্টর এয়ারপোর্টের ওয়েটিং লাউঞ্জটি ছোট। কিন্তু এমন নিখুঁত ভাবে সাজান যে, ছবি মনে হয়। এখানে থাকা মানেই ছবির মধ্যে নিজেকে ঢুকিয়ে দেওয়া। রেবেকা তা করতে পারছে না। তার বারবার মনে হচ্ছে, তাকে এই জায়গায় মোটেই মানাচ্ছে না। সে জড়োসড়ো হয়ে কোণের দিকের একটি চেয়ারে বসে আছে। এবং প্রতি পাঁচ মিনিট পরপর দরজার দিকে তাকাচ্ছে আর ঘড়ি দেখছে।
এ্যান চলে গিয়েছে অনেকক্ষণ হল। বেশ মেয়েটি। হড়বড় করে অনেক কথা বলল। যাবার আগে অবিকল বাংলাদেশী মেয়ের মতো বলল, তোমার গলায় যে মালাটি আছে তা কিনতে তোমার কত টাকা লেগেছে? ডলারে কত হবে?
এক ভরি সোর সাধারণ একটা লকেট। কিন্তু এ্যান মুগ্ধ চোখে দেখছে। টাকাকে ডলারে এমন আগ্রহ নিয়ে কনভার্ট করছে যে, মনে হয় ভোর হওয়ামাত্র সে এরকম একটা লকেট কিনে আনবে। চমৎকার মেয়ে। বিদায় নেবার আগে রেবেকাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। আশ্চর্য কাণ্ড! অথচ এক বার জিজ্ঞেস করল না,আমেরিকায় তোমার ঠিকানা কী হবে? ঠিকানাটা দিয়ে যাও, পরে যোগাযোগ করব।
এত জায়গা থাকতে এক বুড়ো এসে বসল রেবেকার পাশের চেয়ারে। গায়ে গা লেগে যায়, এমন অবস্থা। বুড়োটি ক্ৰমাগত নাক ঝাড়ছে। নাক ঝাড়বার আগে এবং ২৫৬
পরে বিড়বিড় করে বলছে কোন্ড। ড্যাম কোন্ড। লোকটি অসম্ভব নোংরা এবং এমনভাবে নাক ঝাড়ছে যে গা শিরশির করে। রেবেকা বেশ কয়েক বার ভেবেছে একটু দূরে অন্য একটা চেয়ারে সরে বসে। এটা অভদ্রতা হবে ভেবে সে করছে। না।
লাউঞ্জে লোকজন একেবারেই নেই। দু জন বিশালবপু মহিলা একগাদা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে অনবরত কথা বলছে। এরা আমেরিকান নয়। কথাবার্তা শালিক পাখির কিচিরমিচিরের মত। বাচ্চাগুলি ভেণ্ডিং মেশিনে পয়সা ফেলে কিছুক্ষণ পরপরই খাবারদাবার নিয়ে ছুটে আসছে। এই আইসক্রীম, এই অরেঞ্জ জুস, এই একটা স্যাণ্ডউইচ। এত রাতে ছেলেগুলির পেটে রাক্ষসের মতো খিদে কেন? একটা পুতুলের মতো বাচ্চা, সবেমাত্র হাঁটতে–শিখেছে সেও একটা-কী কিনে এনে চারিদেকে ছড়াচ্ছে। বাচ্চার মা দেখেও দেখছে না। হাত নেড়ে-নেড়ে বারবার বলছে–উইইএ উইইএ্যা উইইএ মানে কী? কোন দেশী ভাষা।
বুড়োলোকটি থলথলে চোখে কাল রেবেকার দিকে। তার একটি চোখ লাল হয়ে আছে। চোখের কোণে ময়লা।
তুমি কি ভারতীয়?
রেবেকা মাথা নাড়ল। যার মানে যা হতে পারে, আবার নাও হতে পারে।
যে ডেসটি পরে আছ তার নাম কি সারি?
হ্যাঁ শাড়ি।
ঠাণ্ডা লাগছে না তোমার?
না।
ঠাণ্ডা লাগাবার কথা। খুবই পাতলা কাপড় মনে হচ্ছে, ভেরি থিন।
রেবেকা অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। এখন হয়তো হাত বাড়িয়ে সে শাড়ি পাতলা কি মোটা দেখতে চাইবে।
বুড় প্রচণ্ড শব্দে নাক ঝাড়ল। বিড়বিড় করে বলল, কোল্ড, ড্যাম কোল্ড।
রেবেকার ঠাণ্ডা লাগছে না। তার চেতনা কিছু পরিমাণে অসাড় হয়ে আছে। খিদে লাগার কথা, খিদেও লাগছে না। জীবনের উপর দিয়ে ছোটখাট একটা ঝড় বয়ে গেছে। এত বড় অনিশ্চয়তায় সে কখনো পড়ে নি।
অথচ প্লেনে ওঠার সময় কত বড় বড় কথা একেক জনের। ভয়ের কিছুই নেই। ঢাকা থেকে কুমিল্লা যেতে যে-ঝামেলা তার দশ ভাগের এক ভাগ ঝামেলা ঢাকা থেকে নিউইয়র্ক যেতে। ওঠা আর নামা–ব্যস। এক জন অন্ধকে প্লেনে বসিয়ে দিলে সে যেখানে যাবার ঠিক চলে যাবে।
চাঁদপুরের ঘোটখালু বললেন, তাঁর অফিসের নেজাম সাহেবের এগার বছরের ভাগ্নিকে তারা টিকিট কেটে প্লেনে তুলে দিয়েছেন, সে একা-একা চলে গেছে ভ্যাঙ্কুর। পথে সিয়াটলের এয়ারপোর্ট হোটেলে ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার হিসেবে এক রাত থেকেছে।
ছোটখালু খুব হাতটাত নেড়ে বললেন, এগার বছরের মেয়ের যদি অসুবিধা না হয়, তোর হবে কেন? তুই এত ঘাবড়াচ্ছিস কেন বোকার মতো।
জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টে নামবি। ইমিগ্রেশন পার করবি, তারপর গাঁটগ্যাঁট করে হেঁটে চলে যাবি ডোমস্টিক ফ্লাইট সেকশনে। আবদুল সেখানে থাকবে। সে তোক ফার্গোর প্লেনে তুলে দেবে।
আবদুল চাচা যদি না থাকে?
না থাকলে জিজ্ঞেস করবি ফার্গো যাবার প্লেন কত নম্বর থেকে ছাড়ে। জিজ্ঞেস করবি, ফ্লাইট নাম্বার এন ডাবলিউ টু টু ওয়ান কোত্থেকে ছাড়বে। আর আবদুল থাকবেই। ওর একটা দায়িত্ব নেই?
আবদুল চাচার যতটা দায়িত্ব থাকবে আশা করা গিয়েছিল, ততটা দায়িত্ব তাঁর ছিল না। তিনি আসেন নি এবং রেবেকা পুরোপুরি দিশাহারা হয়ে গিয়েছিল–
এয়ারপোর্টের মত একটা ব্যাপার এত বিশাল হতে পারে।
হাজার হাজার মানুষ। সবাই ব্যস্ত। সবাই ছুটছে। যেন কোথাও কোনো আগুন লেগেছে, এই মুহূর্তে পালিয়ে যেতে হবে। অদৃশ্য কোনো জায়গা থেকে অনবরত ঘঘাষণা দেওয়া হচ্ছে–এ্যাটেনশন প্লীজ। ফ্লাইট নাম্বার টু টু ওয়ান…..