পাঁচ ছেলেমেয়ের জন্যে গুনে গুনে পাঁচ বার চুমু খেল লুসি, তারপর চোখ মুছতে লাগল।
ওয়ারডিংটন বললেন, মাটি আমার সন্তানের চেয়েও বেশি। বেচারার যা অবস্থা এখন, ওকে মেরে ফেলে জীবনের সব কষ্ট দূর করে দেওয়াই উচিত। এইটিই হচ্ছে। ওর জীবনের শেষ ক্রিসমাস।
ওকে মেরে ফেলবেন।
হ্যাঁ। দু-এক দিনের ভেতরই অপ্ৰিয় কাজটা করব। লুসি, তুমি মন শক্ত করেছ তো?
লুসি কিছু বলল না। মাটি লেজ নাড়াতে লাগল। পশুরা অনেক কিছু টের পায়।
ওয়ারডিংটন বললেন, এস রেবেকা, পোর্চে বসি।
রেবেকা পোর্টে গিয়ে বসল। পোর্চ অসম্ভব ঠাণ্ডা। একটা বড় পাত্রে আগুন জ্বালিয়ে মাঝখানে রাখা হয়েছে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় আগুনের পাশে বসে থাকতে ভালোই লাগছে। ওয়ারডিংটন পাইপ ধরাতে-ধরাতে বললেন, তোমাকে এমন মনমরা লাগছে কেন?
রেবেকা কিছু বলল না।
দেশ থেকে কি কোনো খারাপ খবর পেয়েছ?
না।
তাহলে এত মন খারাপ করে আছ কেন?
রেবেকা ক্ষীণ স্বরে বলল, আমার খুব শখ পি-এইচ. ডি করার।
সেই শখ পূরণে তো কোনো বাধা দেখছি না।
রেবেকা থেমে থেমে বলল, আমার ক দিন থেকেই মনে হচ্ছে আমাকে থাকতে দিতে কেউ রাজি হবে না।
কে রাজি হবে না?
আমার বাবা-মা। আমার স্বামী।
তোমার নিজের কেরিয়ার তুমি দেখবে না? কে কী বলল না-বলল, তাতে কী যায় আসে?
সব সময় আমরা নিজের ইচ্ছামতো কাজ করতে পারি না।
কেন পারি না, সেটা আমাকে বল।
রেবেকা চুপ করে রইল।
যুক্তিগুলি কী, আমাকে বল। যুক্তিগুলি শুনি।
ওদের যুক্তি আমার ভালো জানা নেই।
রেবেকা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। তার চোখ ভিজে উঠেছে। এই ভেজা চোখ সে কাউকে দেখাতে চায় না।
চিঠি পেয়ে স্তম্ভিত
মা রেবা,
তোমার চিঠি পেয়ে স্তম্ভিত হয়েছি। কী করে তুমি এমন একটি ডিসিশান একা-একা নিতে পার? এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেবার আগে কারো সঙ্গে তুমি যোগাযোগরও প্রয়োজন মনে করলে না? হুট করে ঠিক করলে পিএইচডি করবে। সুযোগ পেয়েছ-ভালো কথা। সুযোগ পেলেই সব সুযোগ নেওয়া যায় না। সুযোগ মানুষের জীবনে সব সময়ই আসে। একটি দিক দেখলে হয় না, সব দিক দেখতে হয়। চার-পাঁচ বছর তুমি একা-একা আমেরিকায় থাকবে এটা একটা কথা হল? আর জামাই তার চাকরিবারি ছেড়ে তোমার সঙ্গে থাকবে, এটাইবা ভাবলে কী করে? তুমি তোমার ট্রেনিং শেষ হওয়ামাত্র দেশে রওনা হবে। আমার ধারণা আমেরিকায় গিয়ে ওদের চাকচিক্য দেখে তোমার মাথা ঘুরে গেছে। এটা ঠিক না। নিজের অবস্থানটা আগে জানা থাকা দরকার।
ছোট জামাই এখন ঢাকা নেই। সেরাজশাহীতে তার বোনের বাড়িতে গিয়েছে এক সপ্তাহের জন্যে। কাজেই তার সঙ্গে এই মুহূর্তে কোনো আলোচনা করতে পারছি না। তবে আমার ধারণা সে যথেষ্টই বিরক্ত হবে।
মা, তুমি এই নিয়ে আর কোনো লেখালেখি করবে না। চলে আসবে। তোমার মাও এ ব্যাপারে খুব অসুখী। দোয়া নিও।
রইসউদ্দিন
হোট আপা,
তোমার চিঠি পড়ে সবাই খুব আপসেট। সবচে বেশি আপসেট মা। তিনি খুব কান্নাকাটি করছেন। তার ধারণা আমেরিকায় তোমার থেকে যাবার যে-ইচ্ছা, তাঁর পেছনে নিশ্চয়ই অন্য কোনো কারণ আছে।
তুমি তোমার বেশ কিছু চিঠিতে পাশা চৌধুরী নামের এক জন ভদ্রলোকের কথা উল্লেখ করেছ। মার চিন্তা তাকে নিয়ে। আমি জানি এসব খুবই আজেবাজে চিন্তা, তবু আপা–আমার নিজেরও খানিকটা ভয়-ভয় লাগছে। প্লীজ তুমি চলে আস।
ভালো কথা, তুমি ছোট দুলাভাইকেও ঐ ভদ্রলোকের কথা লিখেছ। ঐদিন ঘোট দুলাভাই তা নিয়ে খুব ঠাট্টা-তামাশা করলেন। তুমি সত্যি থেকে গেলে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই ঠাট্টা-তামাশার পর্যায়ে থাকবে না।
দুলাভাই এখন পর্যন্ত তোমার পিএইচডি এনডোলমেন্টের কোনো খবর জানেন না। তিনি ঢাকায় নেই। যখন জানবেন, তখন তাঁর মনের অবস্থা কী হবে, তাই ভেবে খুব খারাপ লাগছে।
টুটুল বরিশাল গিয়েছে বড়ো দুলাভাইকে আনবার জন্যে। কী যে ঝামেলা তুমি তৈরি করেছ আপা! ভালোবাসা নাও। কাল আবার একটা চিঠি দেব।
ফরিদা ইয়াসমিন
আকাশে নক্ষত্রের মেলা
১৪.
নো ড্রাফট দিস মানথ।
লাস্ট মানথ ড্রাফট, স্টিল মিসিং।
বিগ প্রবলেম। ভেরি ওরিড।
১৫
রেবেকা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে দু দিন আগে। বরফে পা পিছলে বাঁ হাতের রেডিও আলনা এবংকলার বোন দুটোই ভেঙেছে। সামান্য পা হড়কান থেকে এমন জটিলতা তৈরী হতে পারে তা তার কল্পনাতেও আসে নি। প্রথম দিনটা তার খুব খারাপ কাটল। একা-একা খানিককক্ষণ কাঁদল। দ্বিতীয় দিনে জ্বরে আচ্ছন্ন হয়ে রইল। অপরিচিত হাসপাতাল, অপরিচিত লোকজনদের মধ্যে এমন নিঃসঙ্গ লাগতে লাগল নিজেকে।
দ্বিতীয় দিনের সন্ধ্যাবেলা পাশা তাকে দেখতে এল। রেবেকা থমথমে গলায় বলল, আপনার জন্যেই আমার এই অবস্থা।
কেন, আমার জন্যে কেন?
আপনি আমাকে বরফে হাটার কায়দা শিখিয়ে দিয়েছেন, সেই কায়দায় হাঁটতে গিয়ে।
পাশা হেসে ফেলল।
রেবেকা গম্ভীর হয়ে বলল, আমার জন্যে কী এনেছেন বলুন? নাকি খালিহাতে রোগী দেখতে এসেছেন?
খালিহাতেই এসেছি।
মার্থা আমাকে একটা কার্ড দিয়ে গেছে। দেখুন কার্ডে কী লেখা।
পাশা হাসিমুখে কার্ডটা পড়ল। কার্ডে লেখা, ভাগ্যকে ধন্যবাদ দাও যে তুমি মানুষ। তুমি ঘোড়া হয়ে জন্মালে তোমাকে মেরে ফেলা হত। পা-ভাঙা ঘোড়াকে সব সময় মেরে ফেলা হয়।
পাশা চেয়ার টেনে পাশে বসতে-বসতে বলল, তোমার শরীর এখন কেমন?
ভালো–তবে জ্বর আছে।
বেশি জ্বর?