দীর্ঘ চিঠি। বড়ো ভাই লিখেছেন, এই জাতীয় একটা চিঠি তিনি ইংরেজি খবরের কাগজেও লিখেছেন, তবে সেই চিঠি ছাপা হয় নি।
এ মাসের ডাফটও পাঠান হয় নি। সামনের মাসে পাঠান হবে এমন কোনো সম্ভাবনা নেই।
পাশা যে জিনিসটা করতে যাচ্ছে, তার নাম হচ্ছে–ড়ুব দেওয়া।
এটা কোন নতুন ব্যাপার নয়। অতীতে অনেকেই করেছে। ভবিষ্যতেও অনেকে করবে।
পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার একটি ছেলে ছিল প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়–সে ক্ৰমাগত সাত বছর দেশে টাকা পাঠাল। প্রতি মাসে এক শ ত্রিশ ডলার। তার বাইরেও মাঝেমধ্যে কিছু বড়ো অঙ্ক। ছোট ভাই পোলট্রি ফার্ম দেবে-পাঁচ শ ডলার। বোনের বিয়ে হবে–পাঁচ শ ডলার। বনগাঁয় জমি রাখা হবে–এক হাজার ডলার।
তারপর হঠাৎ এক সকালবেলা সে ঠিক করল ড়ুব মারবে। এবং যথারীতি তা করল। ড়ুব দেওয়ার পদ্ধতি হচ্ছে ঠিকানা বদলে ফেলা। দেশের কোনো চিঠির জবাব না দেওয়া। প্রথম কয়েক বছর নিজ দেশের কারো সঙ্গে যোগাযোগ না রাখা, কারণ যোগাযোগ রাখলেই মন দুর্বল হয়ে যায়। দেশে টাকা পাঠাতে ইচ্ছা করে।
টেলিফোন বাজছে। পাশা উঠে গিয়ে কোন ধরল।
হ্যালো, পাশা চৌধুরী।
বলছি।
আমি বেল টেলিফোন থেকে বলছি, আমার নাম–
পাশা তাকে কথা শেষ না করতে দিয়ে বলল, আমি তোমাদের টেলিফোন বিল মিটিয়ে দিয়েছি, চেক পাঠান হয়েছে গত পরশু।
হ্যাঁ, তা আমরা জানি। তোমাকে টেলিফোন করা হয়েছে অন্য কারণে।
বল কারণটা।
তুমি জানুয়ারির এক তারিখ থেকে টেলিফোন লাইন ডিসকানেক্ট করতে বলেছ।
হ্যাঁ, বলেছি।
কেউ যদি তোমাকে পুরনো নাম্বারে টেলিফোন করে, তাহলে তাকে কি তুমি নতুন কোন নাম্বার দিতে চাও কিংবা যেখানে যাচ্ছ–তার ঠিকানা দিতে চাও? দিতে চাইলে সেটা আমার কম্পুটারে রেকর্ড করে রাখব। এবং এক সপ্তাহ পর্যন্ত যদি কেউ তোমাকে টেলিফোন করে, তাহলে ম্যাসেজটা পাবে।
আমি কোথায় যাব, তা নিজেও জানি না।
তার মানে কিছু দিতে চাও না?
পাশা কয়েক সেকেণ্ড ভেবে বলল, এই ম্যাসেজটি দেওয়া যেতে পারে –আপনি এই নাম্বারে যাকে খুঁজছেন তিনি নেই। তাঁর কোন ঠিকানাও নেই। কি, দেওয়া যাবে?
নিশ্চয়ই যাবে। মেরি ক্রিসমাস, মিঃ পাশা।
মেরি ক্রিসমাস।
এবার কিন্তু হোয়াইট ক্রিসমাস হচ্ছে, মিঃ পাশা।
তা হচ্ছে।
ওপাশের অল্পবয়স্ক মেয়েটির হয়তো আরো কিছু বলার ছিল। পাশা টেলিফোন নামিয়ে রাখল।
বাড়ি বিশাল
প্রফেসর ওয়ারডিংটনের বাড়ি বিশাল।
ছবিতে দেখা বাড়ির মতই কাঠের তৈরী, রেবেকা মুগ্ধ হয়ে গেল। ওয়ারডিংটন খুব উৎসাহের সঙ্গে রেবেকাকে সমস্ত বাড়ি দেখাতে লাগলেন–
বুঝলে রেবেকা, আমি এবং আমার স্ত্রী–এই দুজনে মিলেই এই বাড়ি তৈরি করতে শুরু করি। সামারে লেকের পাশে তাঁবু খাটিয়ে দুজন থাকতাম, সারা দিন কাজ করতাম। সম্বলের মধ্যে ছিল একটা ইলেকট্রিক করাত আর আমার ল্যাণ্ড রোভার গাড়ি। বন থেকে কাঠ কেটে আনতাম, কপিকল দিয়ে সেই কাঠ উপরে তুলে আস্তে আস্তে নামান হত। এক বার কী হল শোন, লুসি হঠাৎ একটা কাঠ ফেলে দিল আমার হাতে।
লুসি বিরক্ত স্বরে বলল, তুমি এমনভাবে বলছ, যেন ইচ্ছা করে ফেলে। দিয়েছি।
ওয়ারডিংটন হা-হা করে হাসতে লাগলেন।
আমরা এক সামারেই মোটামুটি থাকবার মত ঘর বানিয়ে ফেললাম। কিন্তু মজা কি জান, রেবেকা, ঘর তৈরী হলেও আমরা গোটা সামারটা বনেই কাটালাম। তাই না সুসি?
লুসি জবাব দিল না।
ওয়ারডিংটন বললেন, কেন বনে কাটালাম, সেই গল্প কি এই মেয়েটিকে বলে দেব লুসি?
কেন বেটারিকে গল্প বলে-বলে মাথা ধরিয়ে দিচ্ছ। ওকে নিজের মতো থাকতে দাও।
না, গল্পটা বলেই ফেলি। বুঝলে রেবেকা, আমরা বনে থাকতাম–কারণ সেই সময় আমাদের অনেক পাগলামি ছিল। আদম এবং ঈভের মতো থাকতে হচ্ছিল। হা-হা-হা। আশপাশে তখন এত বাড়ি-ঘর ছিল না, কাজেই আমাদের কোনো অসুবিধা হয় নি। তাই না লুসি? এ কি! এই বয়েসেও তুমি ফ্লাশ করছ, ব্যাপারটা কী?
ওয়ারডিংটন এবং তাঁর স্ত্রী ক্রিসমাস করছেন একা-একা। তাঁদের দুই ছেলে এবং তিন মেয়ের সবাই বাইরে। এক মেয়ে ফিলিপাইনে। ছেলেদের এক জন কোন এক যুদ্ধজাহাজে ভাসছে প্রশান্ত মহাসাগরে। রেবেকা থাকতে থাকতেই ছেলেমেয়েদের টেলিফোন আসতে শুরু করল।
লুসি বলল, আমাদের ক্রিসমাস ট্রী তোমার পছন্দ হয়েছে, রেবেকা?
খুব পছন্দ হয়েছে। এত সুন্দর করে সাজান।
ছেলেমেয়েরা যখন সঙ্গে ছিল তখন ওরা সাজাত, এখন আমাদেরকেই সাজাতে হয়। তখন বেশ খারাপ লাগে। সাজাতে-সাজাতে আমরা দুজনেই কিন্তু কাঁদি। কারণ এখানে অনেক ডেকোরেশন পিস আছে, যার সঙ্গে খুব কষ্টের কিছু গল্প আছে। যেমন ঐ যে রুপোর নেকলেসটা ঝুলছে, ওটা ছিল এলিজাবেথের। ও এগার বছর বয়সে পানিতে ড়ুবে মারা যায়।
লুসি চোখ মুছল।
ওয়ারডিংটন বললেন, আজকের দিনে ঐসব কথা মনে করে কোনো লাভ নেই। তার চেয়ে বরং গিফটগুলি খোল। প্রথমে রেবেকার গিফটগুলি তাকে দাও।
রেবেকা তার গিফট পেয়ে আকাশ থেকে পড়ল। অত্যন্ত দামী একটা ক্যামেরা দিয়েছে লুসি। ওয়ারডিংটন দিয়েছেন একটা মাখনের মতো নরম কম্বল। নিশ্চয়ই খুব দামী জিনিস। এ ছাড়াও গিফট ছিল। তাঁদের যে-মেয়ে কেনসাসে থাকে সে বাবার কাছে শুনেছে ক্রিসমাসের দিন এখানে একজন বিদেশী আসবে, কাজেই সে পাঠিয়েছে এ্যালবাম। সিয়াটলে তাদের হোট ছেলে থাকে, সে পাঠিয়েছে চামড়ার একটা ব্যাগ।
রেবেকার পর মার্টির গিটগুলো খোলা হল। মাটি হচ্ছে তাদের কুকুর। প্রায় অথর্ব। বয়সের কারণে এখন সে আর চোখে দেখে না। কানেও বোধহয় শুনতে পায় না। বিচিত্র সব উপহার পেয়েছে মার্টি। সেই উপহারের সবগুলি অন্ধ ও বধির মার্টির চারপাশে সাজিয়ে দেওয়া হল। ছেলেমেয়েদের সবাই উপহারের সঙ্গে সঙ্গে লিখে দিয়েছে–আমার হয়ে মাটিকে চুমু খাবে।