রেবেকা লক্ষ করল, ক্লাস হবে না শুনে আমেরিকান ছাত্রগুলি বাংলাদেশের ছাত্রদের মতোই হৈ-হৈ করে উঠল, যেন একটি মহানন্দের ব্যাপার ঘটে গেছে। ড. রেলিং বললেন, যে-সব বিদেশী ছাত্রছাত্রী এখনো ক্রিসমাসের ডিনারের। দাওয়াত পায় নি তাদের জন্য আমরা কিছু হোস্ট যোগাড় করেছি। তাদের লিস্ট অফিসে আছে। বিদেশী ছাত্রদের অনুরোধ করা হচ্ছে, তারা যেন পছন্দসই হোস্ট বেছে নেয়।
রেবেকার নিমন্ত্রণ এসেছে দু জায়গা থেকে। প্রফেসর ওয়ারডিংটন এবং ড. রেলিং। কোনটিতে সে যাবে, এখন মনস্থির করতে পারে নি। খালিহাতে নিশ্চয়ই যাওয়া যাবে না। একটা কিছু কিনে নিয়ে যেতে হবে। কী কেনা যায় কে জানে? পাশা ভাইকে নিয়ে যেতে হবে এক বার ওয়েস্ট একারে। ক্রিসমাসের সবচেয়ে বড়ো বাজার নাকি সেখানেই।
রেবেকা খানিকক্ষণ ঘুরে বেড়াল নিজের মনে। এত সকাল-সকাল ডরমিটরিতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। ডরমিটরিতে যাওয়া মানেই নিজের ঘরে গম্ভীর হয়ে বসে থাকা। এর চেয়ে বিশাল ইউনিভার্সিটিতে নিজের মনে ঘুরে বেড়াতে তার বেশ লাগে।
হ্যালো রেবেকা।
রেবেকা তাকিয়ে দেখল রেড চায়নার মি ইন ছোট-ঘোট পা ফেলে এগিয়ে আসছে।
রেবেকা, তুমি কেমন আছ?
একটু আগেই ক্লাসে যার সঙ্গে ছিল, সে এখন তাকে জিজ্ঞেস করছে।-কেমন আছ? রেবেকা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। মি ইন বলল, চল, কফি খাই।
রেবেকা গেল তার সঙ্গে। মি ইন কোনো একটা ব্যাপারে একটু উত্তেজিত। রেবেকা বলল, আমাকে কি তুমি কিছু বলবে?
হ্যাঁ। চল, কফি খেতে-খেতে বলব।
মি ইন যে কথাটি বলল, তার জন্যে রেবেকা ঠিক প্রস্তুত ছিল না।
রেবেকা, এরা আমাকে এই ইউনিভার্সিটিতে একটি টিচিং এ্যাসিস্টেন্টশিপ দিয়েছে। এরা চায় আমি স্প্রিং কোয়ার্টার থেকেই ক্লাস করতে শুরু করি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, চিঠিটা আমার সঙ্গেই আছে। দেখতে চাও?
না, দেখতে চাই না।
মি ইন চিন্তিত মুখে বলল, আমেরিকানরা উদ্দেশ্য ছাড়া কোনো কাজ করে না। এর পেছনে কোন পলিটিক্যাল উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই আছে।
কী উদ্দেশ্য থাকবে?
সেটা বুঝতে চেষ্টা করছি। তোমাকে এই অফার দেবার পেছনে কারণ থাকতে পারে। আমাকে দেবার কারণ নেই। আমি খুবই মিডিওকার এক জন ছাত্রী।
এত ভাবছ কেন? অফার দিচ্ছে যখন, নিয়ে নাও।
নিয়ে নাও বললেই তো নেওয়া যায় না। দেখতে হবে আমার দেশ রাজি হয় কিনা। রাজি হবে না, এটা প্ৰায় ধরেই নেওয়া যেতে পারে।
মি ইন এই ব্যাপারটায় যথেষ্টই বিচলিত হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। সে দ্বিতীয় পেয়ালা কফি নিয়ে এল। রেবেকা কিছু হালকা কথাবার্তা বলতে চেষ্টা করল। কিন্তু মি ইনের মন নেই।
রেবেকা বলল, মি ইন, এই ছবিটা দেখ। কেমন চমৎকার একটা কাঠের বাড়ি, দেখলে?
হুঁ, দেখলাম।
পাঁচ হাজার ডলার থাকলেই এই বাড়িটা কেনা যায়। আমার কাছে যদি থাকত, আমি কিনতাম।
এত বড় একটা বাড়ির তোমার দরকারটা কী?
আরে, মেয়েটা বলে কি! দরকার না থাকলে বুঝি বিশাল একটা বাড়ি থাকতে পারবে না?
মি ইন বলল, ছবিতে বাড়িটা যত সুন্দর লাগছে, আসলে তত সুন্দর নয়। ছবিতে সব জিনিস ভালো দেখায়।
আমেরিকা তুমি সহ্যই করতে পার না। তাই না মি ইন?
হ্যাঁ, তাই, নোংরা আমেরিকানদের কোন কিছুই ভালো হতে পারে না।
রেবেকা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, চল না–বাড়িটা দেখে আসি। ক্রিসেন্ট লেকের পাশেই বাড়ি। কাছেই তো। একটা ক্যাব নিয়ে যাব।
পাগল নাকি তুমি।
কেন, অসুবিধা কী?
শুধু শুধু এই বাড়ি দেখে কী হবে! তুমি তো আর কিনছ না?
কিনতে ইচ্ছে করে যে
মি ইন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বাংলাদেশী এই মেয়েটি অদ্ভুত। পড়াশোনায় খুব তুখোড়। এবং বেশ সাহসী। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব যে-দেশে হয় নি, সে-দেশের মেয়েরা সাহসী হয় না বলে একটি কথা প্রচলিত আছে–তা সম্ভবত ঠিক নয়।
রেবেকা, চল ওঠা যাক।
তুমি যাও, আমি একটু বসব।
একা-একা বসে থাকবে?
একা কোথায়, এত লোকজন?
মি ইন চলে যেতেই রেবেকা বোনের চিঠি খুলল। বাড়ির চিঠিগুলি সে সাধারণত রাতে শোবার সময় পড়ে। পড়তে পড়তে তার চোখ ভিজে যায়। কত ছোটখাট সুখস্মৃতি মনে পড়ে সমস্ত হৃদয়কে অভিভূত করে দেয়।
আপা, তোমার দেশে ফেরার দিন তো ঘনিয়ে এল। সিরিয়াস একটা রিসেপশন আমরা তোমাকে দেব। এয়ারপোর্টে হাজির হব ফুলের মালা নিয়ে। এখনি তার প্রস্তুতি চলছে। মা সব আত্মীয়স্বজনকে চিঠি দিয়েছেন তোমার আসবার তারিখ জানিয়ে।
এদিকে ছোট দুলাভাইও মনে হয় তোমার বিরহে খানিকটা কাতর। তাঁর ঘরে গিয়ে দেখি, তোমাদের একটা বিরাট ছবি বাঁধান। এরকম কায়দা করে তুমি ছবি কখন তুললে, তা তো জানি না। স্টুডিওতে তোলা ছবি নিশ্চয়ই। ছবিতে তোমাকে খুব ফর্সা লাগছে। আর দুলাভাইকে বেশ বোকা-বোকা লাগছে।
ভালো কথা, দুলাভাই হঠাৎ কী মনে করে গোফ রাখতে শুরু করেছিলেন। আমি এবং টুটুল স্ট্রং প্রোটেস্ট করায় সেই গোঁফ হেঁটে ফেলা হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে, গোঁফ থাকা অবস্থাতেই ভালো দেখাচ্ছিল। তোমার কাছে দুলাভাইয়ের একটা গোফলা ছবি পাঠালাম। তুমি তোমার মতামত জানিয়ে চিঠি দেবে। তুমি যদি ইয়েস বল তাহলে আবার গোীফ রাখান হবে।
এখন দিচ্ছি সবচে ইন্টারেস্টিং খবরটি। হোট দুলাভাই ওদের বাড়ির দোতলায় একটা ঘর তুলছেন–তুমি এসে ঐ ঘরে উঠবে। দুলাভাইয়ের এক আর্কিটেক্ট ফ্রেণ্ড ডিজাইন দিয়েছেন। শোবার ঘরের সঙ্গে ছোট্ট একটা ড্রেসিংরুম। বিরাট এ্যাটাচড় বাথ।