আজ বুধবার। দেশের চিঠি আসার কথা নয়। সাধারণত দেশের চিঠি আসে সোম এবং মঙ্গলবারে। তবু রেবেকার মনে হতে লাগল, তার চিঠি আছে। যেটা খুব বেশি মনে হয় সেটা সাধারণত হয় না। কাজেই সে প্ৰাণপণে ভাবতে চেষ্টা করল, আজ কোন চিঠি পাওয়া যাবে না। মেইল-বক্স থাকবে ফাঁকা।
কিন্তু বেশ কয়েকটি চিঠি ছিল। এর মধ্যে একটি দেশের। খামের উপরে বাংলায় লেখা, প্রেরক ফরিদা ইয়াসমিন। শুধু প্রেরকের নাম নয়, প্রাপকের নামও লেখা বাংলায়। এদের কি বুদ্ধিশুদ্ধি কোনোকালে হবে না? বাংলা নামটা এখানে পড়বে কে? এরা যে বুদ্ধি করে রেবেকার মেইল বক্সে রেখে গেছে–তাই যথেষ্ট।
ফরিদার চিঠি ছাড়া আর যা এসেছে, তার সবই বোধহয় জাঙ্ক মেইল। জিনিসপত্র বিক্রি করার আমেরিকান কায়দা। তারা এই সব চিঠি কি বেছে বেছে বিদেশীদের পাঠায়? হয়তো ভাবে, বোকা বিদেশীরা এই ফাঁদ বুঝতে পারবে না। রেবেকাকে একটি চিঠি লিখেছে সিয়াটলের এক ঘড়ি কোম্পানি, লিখেছে–মিসেস রেবেকা ইয়াসমিন, আপনি আমাদের অভিনন্দন গ্রহণ করুন। কারণ আপনি একটি প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করেছেন। প্রতিযোগিতাটি হয়েছে আপনার অগোচরে। আমরা সমগ্র আমেরিকার পঞ্চাশ জন ভাগ্যবান ব্যক্তির একটি তালিকা করেছি, তাতে আপনার নাম উঠেছে। আমরা আপনাকে প্ৰতিযোগিতায় জয়লাভের কারণে একটি কোকিল-ঘড়ি পাঠাচ্ছি। জিনিসটি জার্মান কারিগর কর্তৃক হাতে তৈরী। এবং প্রায় দুশ ডলার মূল্যের এই অপূৰ্ব ঘড়িটি দেওয়া হবে মাত্র উনিশ ডলারে।
রেবেকা ভেবে পায় না এরা এত তাড়াতাড়ি তার নাম জানল কী করে? নাম জানার এই কষ্টটি করবার জন্যেই কি ওদের কাছ থেকে একটি ঘড়ি কেনা উচিত নয়?
আজ দুটি চিঠি এসেছে রিয়েল স্টেট বিজনেসের লোকজনদের কাছ থেকে। তারা জানতে চাচ্ছে, রেবেকা কি এখানে কোন বাড়ি কিনতে আগ্রহী? পাঁচ হাজার ডলার ডাউন পেমেন্ট দিয়ে সে এই মুহূর্তে একটি বাড়ি কিনতে পারে। বাড়ির দাম মাসিক কিস্তিতে শোধ করতে হবে। সুদের হার শতকরা তের ভাগ। তারা বেশ কিছু বাড়ির ছবি পাঠিয়ে দিয়েছে।
এমন চমৎকার সব বাড়ি যে দেখলেই কষ্ট হয়। একটি কাঠের বাড়ি খুব মনে ধরল রেবেকার। লেকের পাশে দোতলা বাড়ি। বিশাল এক বারান্দা। সেখানে পুরনো আমলের একটি ইজিচেয়ার পাতা আছে। দেখলেই শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। বাড়িটাকে ঘিরে আছে বিশাল পাইনগাছের সারি। ছবিটি তোলা হয়েছে বাতাসের মধ্যে, কারণ পাইনগাছগুলি এক পাশে হেলে আছে। লাল স্কার্ট-পরা একটি মেয়েও দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির সামনে, বাতাসে তার চুলও উড়ছে।
এই রকম একটি বাড়ি থাকলে জীবনটা কি অন্য রকম হয়ে যেত না? বিকেলবেলায় বিশাল বারান্দায় বসে চা খেত। লাল স্কার্ট-পরা মেয়েটির মতো ফুল উড়িয়ে হাঁটত পাইনগাছের নিচে। জোৎস্নারাতে তার বরকে সঙ্গে করে নৌকা নিয়ে বেড়াতে যেত হ্রদে। আহু, কী অপূর্ব জীবন এদের।
রেবেকা ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে অন্য চিঠিগুলি দেখতে লাগল। একটা চিঠি এসেছে নৰ্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিনের কাছ থেকে। রেবেকাকে জানান হয়েছে যে, তাকে গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট হিসেবে নেওয়া হয়েছে স্প্রিং কোয়ার্টার থেকে। তাকে ফুী টিউশন দেওয়া হয়েছে এবং এ ছাড়াও প্রতি মাসে তাকে দেওয়া হবে চার শ পঁচাত্তর ডলার। ভিসাসংক্রান্ত ব্যাপারগুলি মেটার জন্যে তাকে অবিলম্বে ফরেন স্টুডেন্ট এ্যাডভাইজারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। সত্যি তাহলে ব্যাপারটা ঘটেছে। এবার বোধহয় খবর জানিয়ে সবাইকে চিঠি লেখা যাবে। চিঠি পড়ে ওদের কী অবস্থা হবে কে জানে? কেউ নিশ্চয়ই বিশ্বাসই করতে চাইবে না। তাদের আত্মীয়স্বজনদের কেউই পি-এইচ. ডি ডিগ্ৰীওয়ালা নেই। দুরসম্পর্কের এক মামা আছেন এম.আর.সি.পি.। ভদ্রলোক কখনো কাউকে চিনতে পারেন না। রেবেকার তাড়াহুড়োর বিয়ের পর একটা টি-পার্টির ব্যবস্থা হল। সব আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত দেওয়া হল। এম.আর.সি.পি, মামাকেও দেওয়া হল। টুটুলের বক্তব্য হচ্ছে, দীর্ঘ সময় ভদ্রলোক চিনতেই পারেন নি কার বিয়ে হয়েছে। তারপর নাকি এমন একটা ভঙ্গি করেছেন, যার মানে হচ্ছে চিনতে পারি নি, তাতে কি? পৃথিবীর সবাইকে তো আর চেনা যায় না। দেখি, সময় পেলে যাব।
শেষের অংশটা টুটুলের বানানট। সে খুব বানিয়ে কথা বলে। মামা ভদ্রলোক দাওয়াতে এসেছিলেন। বাঁশের তৈরী একটা ফুলদানি প্রেজেন্ট করেছিলেন। টুটুলের ধারণা, সেই ফুলদানিটা তিনি নিজেই বাঁশ চেছে বানিয়েছেন। টুটুল দারুণ ফাজিল হয়েছে।
গত কয়েক দিন ধরে ক্লাসগুলি কেমন টিলেঢালা হয়ে গেছে। ক্লাস শেষ হওয়ামাত্র কুইজ হচ্ছে না। এটা নাকি করা হচ্ছে ক্রিসমাসের কারণে। যাবতীয় পরীক্ষা নিয়ে যাওয়া হয়েছে ক্রিসমাসের পর। বিদেশীরা তাদের পড়ালেখা যাবতীয় উৎসবের বাইরে রাখে বলে যে কথাটি প্রচলিত, তা ঠিক নয়। আমরা যেমন কিছু কিছু রোজার ঈদের পরে নিয়ে যাই, এরাও তাই করে। পরীক্ষায় নকলের ব্যাপারটাও তার চোখে পড়েছে। একটি আমেরিকান ছেলে বইয়ের পাতা কেটে হাঁটুর ওপর রেখে লিখছে, এই দৃশ্যটি তার নিজের চোখে দেখা।
দুপুরবেলা ড. রেলিং-এর একটা ক্লাস ছিল। কেমিকেল প্ৰিজারভেটিভস-এর উপর। ড. রেলিং এসে জানালেন তিনি ক্লাসটা নিতে পারছেন না। কারণ প্রচণ্ড সর্দিতে তাঁর নাক বন্ধ। তিন ঘন্টার ভেতর ছটা টাইলান খেয়েও কিছু হচ্ছে না।