হাসপাতালের শেষ কটা দিন তার বড়ো অস্থিরতায় কেটেছে। বারবার উঠে বসে বিহুল সুরে বলেছে, মাজেদা, ও মাজেদা–তোমাকে বড়ো ঝামেলায় ফেলে যাচ্ছি। কী করি বল তো? কী করা যায় এখন?
পাশা হোট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। মেজ ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের কোনো খবর বড় ভাইয়ের চিঠিতে থাকে না। ওরা কেমন আছে? কত বড় হয়েছে? মাজেদা ভাবীই-বা কেমন আছেন? ড্রাফট না পাওয়ার দুঃশ্চিন্তা তাঁকে কী রকম কাবু করেছে? তিনিও কি তাঁর দুই মেয়ে এবং এক ছেলে নিয়ে শুকনো মুখে ঘুরঘুর করছেন?
টেলিফোন বাজছে।
পাশা এগিয়ে গেল। কে টেলিফোন করেছে? রেবেকা? সময়ে-অসময়ে এই মেয়ে ফট করে একটা টেলিফোন করে বসে। তার নিরিনে গলা শোনা যায়। হ্যালো শোনেন, পাশা ভাই, বাংলায় কথা বলার জন্যে ফোন করলাম।
ভালো করেছ, এখন কথা বল।
আজ বাসা থেকে কটা চিঠি পেয়েছি বলেন দেখি?
তিনটা।
হল না, পাঁচটা। এটা হচ্ছে আমার হাইয়েস্ট রেকর্ড।
স-ব বাসার চিঠি?
হুঁ। দুটা এসেছে আমার কর্তার কাছ থেকে। একটা এসেছে আমার বড়োআপার কাছ থেকে, বরিশাল থেকে লেখা। অনেক আগে লেখা, আসতে দেরি হয়েছে কেন জানেন? জীপ কোড দেয় নি, তাই। হ্যালোপাশা ভাই।
বল।
আমাদের সামনের বাসায় এক রিটায়ার্ড জজ সাহেব থাকেন, আপনাকে বলেছিলাম না?
হ্যাঁ, বলেছিলে।
তাঁর স্ট্রোক হয়েছে। এখন পিজিতে।
তুমি মনে হয় খুব চিন্তিত।
এক জন অসুস্থ আর আমি চিন্তিত হব না? কী যে কথাবার্তা আপনারা খুব রাগ লাগে। হ্যালো, শুনুন।
শুনছি।
এই জজ সাহেবের একটি মেয়ে আছে, এত সুন্দর–মনে হয় তুলি দিয়ে। আকা।
তুমি আমাকে আগে বলেছ।
দাঁড়ান, আপনাকে ছবি দেখাব। ছবি দেখলে এই মেয়েকে বিয়ে করবার জন্য পাগল হয়ে যাবেন।
সুন্দরী মেয়ে দেখলেই ছেলেরা বিয়ের জন্য পাগল হয়ে যায়, এটা ভাবা ঠিক না।
পাশা ভাই, আমি এখন রেখে দিচ্ছি, পরে কথা বলব।
ঠিক আছে।
ও, ভালো কথা, আজ কয়েকটা ছবি এসেছে বাসা থেকে। সব ব্ল্যাক এও হোয়াইট।
তোমার কর্তার ছবি আছে?
হুঁ।
সেই ছবি কি আঁচলে লুকিয়ে ঘুরঘুর করছ?
হ্যাঁ, করছি। রাখলাম টেলিফোন।
আজকের টেলিফোন রেবেকার কাছ থেকে আসে নি। পাশার বেশ মন খারাপ হয়ে গেল। সে ধরেই নিয়েছিল টেলিফোন এসেছে রেবেকার কাছ থেকে।
পাশা চৌধুরী?
হ্যাঁ।
আমি এ্যাপল গেমস থেকে বলছি–পিআরও। আমার নাম জন।
হ্যালো জন।
তোমার খেলাটি মনোনীত হয়েছে।
পাশা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এপল গেমস থেকে যথাসময়ে টেলিফোন না আসায় সে ধরেই নিয়েছিল, খেলাটি ওদের পছন্দ হয় নি।
জন, তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। তবে একটি ছোট সমস্যা আছে।
কী সমস্যা?
তোমার খেলাটি ডিপ্রেসিং ক্রিসমাস স্পিরিটের সঙ্গে খাপ খায় না। ক্রিসমাসের খেলা হবে আনন্দের। কিন্তু তোমার খেলাটিতে আনন্দের কিছু নেই। একটি নিরানন্দ বিষয় নিয়ে তুমি কাজ করেছ। আশা করি কথাটা তুমি স্বীকার করবে।
পাশা চুপ করে রইল।
যালো মিঃ পাশা।
বল, শুনছি।
তুমি কি খেলার ফরম্যাট ঠিক রেখে এটাকে একটা আনন্দের খেলায় বদলে। দিতে পার না?
তা কী করে সম্ভব?
যেমন মনে কর, একটি ছেলে নির্দিষ্ট ডলার নিয়ে এক ছুটির দিনে ডেট করতে বের হয়েছে। এটা হচ্ছে আমাদের একটা সাজেশান। তুমি অন্য ভাবেও এটা করতে পার। পার না?
পাশা জবাব দিল না।
তুমি এটা বদলে দিলে আমরা খেলাটা কিব। রাজি থাকলে টেলিফোনেই রয়েলিটির ব্যাপারটা নিষ্পত্তি হতে পারে। মোট রয়েলিটির ওপর কিছু বোনাসও দেওয়া হবে। ক্রিসমাস প্রোডাকশন, সেই কারণেই বোস। তুমি কি রাজি আছ?
না। খেলাটা যেভাবে আছে, আমি সেটাকে সেভাবেই রাখতে চাই।
এ ব্যাপারে ইচ্ছা করলে তুমি একটা সেকেণ্ড থট দিতে পার।
আমি এই নিয়ে আর ভাবতে চাই না।
পাশা টেলিফোন নামিয়ে রাখল। তার সামনে খুব একটা খারাপ সময়। জমান টাকা দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। তারপর? তারপর কী? তার কোনো গ্রীন কার্ড নেই। সে অসংখ্য ইললিগ্যাল এলিয়েনদের একজন। কেউ তাকে কাজ দেবে না।
দেশে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। কী করবে সে দেশে গিয়ে? তার কোনো ডিগ্রী নেই। পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়েছে–টাকার যোগাড় করা যায় নি। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পয়সায় পড়াশোনা করা সবার হয়ে ওঠে না। তার হয় নি, ফরিদের হয় নি। অথচ তারা দুজনই কি আমেরিকান ছাত্রদের চমকে দেয় নি, বিশেষ করে ফরিদ? পরপর চার বার ডিনস লিস্টে তার নাম গেল। ড. টলম্যানের আগ্রহে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং মেজর বদলে তারা চলে এল কম্পুটারে, কারণ। টলম্যানের ভাষায় কম্পুটার সায়েন্সে দরকার সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রদের।
জ্বর আসছে নাকি?
পাশা কপালে হাত দিয়ে উত্তাপ পরীক্ষা করল। শরীর খারাপ লাগছে। টেবিলল্যাম্পের আলো চোখে লাগছে। চোখ করকর করছে।
খেলাটি বদলে দিলে হত না?
না, তা ঠিক হত না। সারা জীবন সে পরাজিত হয়েছে। আর পরাজিত হতে ইচ্ছা করছে না।
কেন করছে না?
রেবেকা মেয়েটির কারণে কি? এই শ্যামলা মেয়েটি কি কোনো বিচিত্র উপায়ে তার ভেতর অহংকার জাগিয়ে তুলেছে।
পাশা অবেলায় ঘুমিয়ে পড়ল। এবং অনেক দিন পর মাজেদা ভাবীকে স্বপ্নে দেখল। ভাবী যেন খুব চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছেন। তাঁর গোলগাল মুখটি কেমন লম্বাটে হয়ে গেছে। তিনি খুব হাসছেন।
রেবেকার অভ্যেস
রেবেকার অভ্যেস হচ্ছে প্রতিদিন কম করে হলেও চার-পাঁচ বার মেইল-বক্স পরীক্ষা করা। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে যখনই সময় পায় তখনই একতলায় চলে যায়। চৌষট্টি লেখা ছোট্ট খোপটি খোলে। এই সময় তার বুক কাঁপতে থাকে। প্রথম দিকে সারাক্ষণই মেইল-বক্স ফাঁকা থাকত। তার মনে একটা সন্দেহ থাকত, হয়তো ভুলে তার চিঠি অন্য কারো খোপ চলে গেছে। সেই সন্দেহটা এখন আর হয় না। আমেরিকানরা কাজ করে নির্ভুল, এই বিশ্বাস তার হচ্ছে।