ছিল মানে? এখন নেই?
স্যুটকেসে ছিল। সেই সুটকেস কোথায় আছে জানি না। খোঁজখবর করতে পারি নি। আমার ইংরেজি ওরা বোঝে না, আমিও ওদের কথা বুঝি না।
ওদের কথা না বুঝতে পারার কারণ আছে, কিন্তু আপনার কথা ওরা বুঝবে না কেন? এখানে কী জন্যে এসেছেন?
ইউ-এস এইড প্রোগ্রামে এসেছি। তিন মাসের শট ট্রেনিং, ফুড টেকনলজিতে। এয়ারপোর্টে ওদের লোক থাকার কথা। কেউ নেই।
আপনার নাম কী?
রেবেকা। আমার নাম রেবেকা ইয়াসমিন।
আমি আসছি। ত্ৰিশ থেকে পঁয়ত্রিশ মিনিট লাগবে। নিশ্চিন্ত হয়ে অপেক্ষা করুন। যে-আমেরিকান মেয়েটির সঙ্গে প্রথম কথা বললাম, সে কি আছে না চলে গেছে?
আছে এখনো, কিছু বলবেন?
না।
পাশা টেলিফোন নামিয়ে পারকুলেটর চালু করল। এক কাপ গরম কফি না খেয়ে বের হওয়া যাবে না। ভয়ানক ঠাণ্ডা পড়েছে। চিল ফেক্টর নিয়ে তাপমাত্রা শূন্যের তিন ডিগ্রী নিচে নেমেছে। অথচ নভেম্বর মাস।
গাড়ি চালু হল সহজেই। ইঞ্জিন গরম করতে দিয়ে কফি নিয়ে বসল এবং আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করল, মাঝরাতের এই ঝামেলাটা তার ভালোই লাগছে।
এর কারণ কি ফ্রয়েডিয়ান? একটি ছেলে বিপদে পড়ে মাঝরাতে টেলিফোন করলে পাশা নিশ্চয় বিরক্ত হত। বিরক্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখন বিরক্তি লাগছে না। ভালোই লাগছে। পাশা লক্ষ করল, সে মেয়েটি সম্পর্কে যথেষ্ট কৌতূহল অনুভব করছে। কল্পনায় যে-ছবিটি ভাসছে, তা হচ্ছে আসমানী রঙের একটা শাডি গায়ে মেয়েটি শুকনো মুখে লাউঞ্জে বসে আছে। তার গায়ে লাল রঙের একটা সোয়েটার। ধবধবে সাদা রঙের মাফলারে কান-মাথা ঢাকা। এই মাফলারটি বিদেশযাত্রা উপলক্ষে তার মা কিংবা বড় বোন কিছুদিন আগেই বুনে শেষ করেছেন।
মেয়েটির বয়স কত হতে পারে? গলার স্বর মিষ্টি। কিশোরীদের মতো কাঁচা। তাতে কিছু বোঝা যায় না। অনেক বৃদ্ধা মহিলারও কিশোরীদের মতো নিরিনে গলা থাকে। মিসেস থমসনের বয়স প্রায় সত্তর। কিন্তু তিনি কথা বলেন বালিকাদের গলায়।
পাশা কাপড় পরতে শুরু করল। বাইরে যাবার জন্য কাপড় পরা একটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। থারমাল আণ্ডারওয়ার। গরম পুলওভারের উপর পার্ক। কানঢাকা টুপি। মেয়েটির জন্যেও গরম কাপড় নিয়ে যেতে হবে। শূন্য ডিগ্রীর নিচের তাপমাত্রা সম্পর্কে এদের কোনো ধারণা নেই। বাইরে বের হলে প্রথম কিছুক্ষণ মনে হবে–এমন কিছু ঠাণ্ডা তো নয়। তার পরই স্নায়ুতে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা লাগবে। বুক ব্যথা করতে শুরু করবে।
পাশা গাড়ি স্টার্ট দিয়ে মেয়েটি সম্পর্কে একটি ছবি দাঁড় করাতে চেষ্টা করল। ফরিদের ভাষায় এনালাইটিক্যাল রিজনিং ব্যবহার করে সিদ্ধান্তে যাওয়া।
রেবেকা নামের মেয়েটির বয়স অল্প হবার কোন সম্ভাবনা নেই। ইউএস এইড প্রোগ্রাম-কাজেই সে কৃষি বিভাগে কাজটাজ করে। এসব স্কলারশিপ সিনিয়ারিটি দেখে দেওয়া হয়, কাজেই মেয়েটি যথেষ্ট সিনিয়ার।
মেয়েটি বিবাহিত। কারণ একটি অবিবাহিত মেয়েকে বাবা-মাকিছুতেই একাএকা এত দূর পাঠাবেন না।
সে এক জন বিশালদেহী মহিলা। কারণ তার গলার স্বর মিষ্টি। ভারি মানুষদের গলা সাধারণত মিষ্টি হয়। ভোকাল কর্ডের সঙ্গে শরীরের মেদের একটি সম্পর্ক আছে।
নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। কারণ শীতের দেশে আসছে বলেই তারা একটি মাফলার বুনে দিয়েছে। এসব জায়গার শীত সম্পর্কে এদের কোনো ধারণা নেই। বাইরে যাবার আগে কিছু একটা বুনে দেওয়া বা সেলাই করে দেওয়ার মত সেন্টিমেন্ট নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারই দেখায়। পাশার এক বার মনে হল, তার এনালাইটিক্যাল রিজনিং-এ একটু খুঁত আছে। সে ধরেই নিয়েছে মাফলারটি হাতে বোনা। এটা নাও হতে পারে। হয়তো এটা কেনা জিনিস।
রেবেকা নামটিও পুরন। স্কুল-মিস্ট্রেসদের নামের মতো। এই নামটি পরিষ্কার বলে দেয়–এই মেয়ে একালের মেয়ে নয়। একালের মেয়েদের নাম হয় ত্ৰপা বা মৌলি।
পাশা ক্যাসেট চালু করল। কোনো শব্দ হল না। ঘাঁসৰ্ঘাস আওয়াজ। হেড পিস নষ্ট হয়ে গেছে, আর নতুন কেনা হয় নি। বেশ ক দিন ধরেই এটা নষ্ট। তবু কেন মনে পড়ল না! এসব কি বয়সের লক্ষণ? আটত্রিশ বছর কি খুব একটা বেশি বয়স? এ দেশের জন্যে নিশ্চয়ই নয়? মানুষের আয়ু বেড়ে গেছে। সুষম খাদ্য, চিকিৎসা, উন্নত জীবনযাত্রা। মানুষের আয়ু সভ্য দেশগুলিতে বাড়তেই থাকবে, এবং এক সময় মানুষ হয়তো অমর হয়ে যাবে। বইপত্রের অমরতা নয়। সত্যিকার অমরত্ব। ইটারনেল লাইফ।
দৈত্যের মত একটা ট্রাক বাতাস কাঁপিয়ে শোঁ-শোঁ করে আসছে। হর্ন দিয়েছে। ওভারটেক করতে চায়। কয়েক মুহুর্তের জন্যে পাশার মনে হল, তার পুরনো মরিস মাইনরটি ট্রাকের গায়ে তুলে দিলে কেমন হয়? চিন্তাটা মুহূর্তের জন্যে হলেও এর জন্ম চেতনার গভীরে।
অমরত্বের পাশাপাশি সব মানুষের মধ্যেই বোধহয় থাকে মৃতের জন্যে আকাঙ্খা। মানুষের মত বিচিত্ৰ প্ৰাণী কি আর আছে এই নক্ষত্রপুঞ্জের?
পাশা সরে গিয়ে ট্রাকটিকে পাস করবার জন্যে অনেকখানি জায়গা করে দিল। ছুটন্ত দানবের গা থেকে বাতাসের ধাক্কা লাগল মরিস মাইনরে। পাশা ছোট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। আমাদের কর্মকাণ্ড সমস্তই অমরত্বের জন্যে। সবাই অবিনশ্বর হতে চাই। আমরা আমাদের ছায়া রেখে যেতে চাই ছেলেমেয়েদের মধ্যে। মাইকেলেঞ্জেলদার পাশাপাশি বাংলাদেশের গ্রামের অখ্যাত কারিগরও মাটির তাল হাতে নিয়ে মূর্তি গড়ে। এরা কেউ থাকবে না। মাইকেলেঞ্জেলোর ডেভিড থাকবে। গ্রাম্য ভাস্করের মাটির মূর্তিটিও থাকবে। অমরত্ব। ইটারনেল লাইফ মাই ফুট।