সবচে বড়ো কথা, মিতা যে এক শ ডলার পেয়েছে, এই ঘটনাটা সে আমাকে জানায় নাই। আমি অন্য লোকের মারফত খবর পেলাম। এখন তুমিই বল, আমাকে না জানানর কারণ কী? আমি কি টাকাটা নিয়ে নিতাম? এই হচ্ছে এদের মানসিকতা। ছিঃ ছিঃ।
তোমার বিবাহের ব্যাপারে এক জায়গায় আলাপের কথা ভাবছি। মেয়ের বাবা রিটায়ার্ড এস পি। ঢাকা শহরে নিজের তিনতলা বাড়ি আছে। ভদ্রলোকের দুই মেয়ে,
কোনো ছেলে নাই। বাবার সম্পত্তির মেয়েরাই ওয়ারিশান। মেয়ে দেখতে খারাপ না। লম্বা চুল। এই বিষয়ে তোমার মতামত জানাবে। তার চেয়েও বড়ো কথা, ডাফটির ব্যাপারে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খোঁজ নিবে। আমরা একমতো আছি।
পাশা লক্ষ করল–এই প্রথম বড়ো ভাইয়ের চিঠি থেকে তোমার ভাবীর শরীর ভালে যাচ্ছে না–এই লাইনটি বাদ গেছে।
সে বড় ভাইয়ের বর্তমান অবস্থাটি কল্পনা করতে পারে। চিন্তিত মুখে রোজ এক বার পোস্ট অফিসে গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন। কুন্দুস সাহেবের কাছে যাচ্ছেন ডলারের দর জানবার জন্যে। বাড়িতে আসছেন মেজাজ খারাপ করে। একটি ড্রা যথাসময়ে না আসায় গোটা পরিবার শঙ্কিত হয়ে অপেক্ষা করছে।
যখন এরা সত্যি-সত্যি জানবে ড্রাফট মিসিং হয় নি, তখন কী হবে? বাংলাদেশের আরো কিছু পরিবারের মত তাদের এই পরিবারের আশা-আকাঙ্ক্ষা একটা নির্দিষ্ট তারিখে আসা ড্রাফটের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই পরিবারের কর্তা ড্রাফট ভাঙানর কলাকৌশল ছাড়া অন্য কিছুই তেমন জানেন না।
এক জন দুর্বল পিতার ঔরসে সবল পুত্ৰ-কন্যারা জন্মাতে পারে না। পাশা চৌধুরীর বাবা নিজাম চৌধুরী এক জন দুর্বল মানুষ ছিলেন। ফুড কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টের হেডক্লার্ক নিজাম চৌধুরীর জীবনের একমাত্র সাফল্য ছিল–পরিচিত এক অসুস্থ ব্যবসায়ীর হয়ে বদলিহজ্ব করা। নিজাম চৌধুরী এই ব্যাপারটি ঠিক কীভাবে ম্যানেজ করেছিলেন, সেটা পরিষ্কার নয়। কিন্তু এই সাফল্যে তিনি অভিভূত হয়ে গেলেন। জীবনের বাকি কটা দিন তাঁর কাঁটল হজ্বের গল্প করে।
আরে ভাইসাব, কী দেশ। কী খাওয়া-খাদ্য, কী ফলফলারি। সব কিছু বেসমার। আর পানির কথা কী বলব ভাইসাব। কী পানি। ভরপেটে এক ঢোক পানি খান–সব হজম। সঙ্গে সঙ্গে খিদা লাগে। আল্লাহ্ পাকের খাস রহমত আছে। পানির উপরে।
হযরে আছোয়াতে যখন চুমু দিলাম–বুঝলেন ভাইসব, শরীরের ভেতর দিয়ে একটা ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। হাই ভোন্টের ইলেকট্রিসিটি। এই দেখেন, গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেছে। হাত দিয়ে দেখেন। চুমু দিয়ে চোখে পানি এসে গেল। আহ কী রহমত, আল্লাহ পাকের কী নিয়ামত। ফাবিয়ে আলা রাৰি তুকাজজিবান।
কাবা শরিফের গল্প করে বাকি জীবনটা পার করে দিতে পারলে ভালেই হত। কিন্তু নিজাম সাহেব একটা ঘুষের মামলায় পড়ে গেলেন। জেল-জরিমানা হয়ে যেত। হযরে আছোয়াতে চুমু খাওয়ার পুণ্যেই হয়ত চাকরিটা গেল। জিপি ফাণ্ডের টাকা, পেনসনের টাকা–এই সব বের করবার জন্যে প্রচুর পরিশ্রম করতে লাগলেন।
পাশার বড়োভাই সেই কষ্টে যোগাড় করা টাকায় নানা রকম অদ্ভুত ব্যবসা ফাঁদতে লাগলেন। তাঁর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক-বাবার চাকরি চলে যাওয়াতে শাপে বর হয়েছে। ব্যবসা করে সংসারের অবস্থা পাল্টে ফেলার সুযোগ পাওয়া গেছে। নিজাম চৌধুরীও জ্যেষ্ঠ পুত্রের ধারণা সমর্থন করতেন। কথায় কথায় বলতেন, ব্যবসার মতো জিনিস আছে নাকি? রসুলে করিম নিজে ব্যবসা করেছেন। রুজি রোজগারের আশি ভাগই হচ্ছে ব্যবসাতে। দেখ না এখন সংসারের কী অবস্থা হয়।
সংসারের অবস্থা দেখার মতোই হয়। দু বেলা রুটি এবং ডালের ব্যবস্থা হয়। নিজাম সাহেব খেতে বসে দু বেলাই ছোটখাট একটা ভাষণ দেন, ডাল-রুটির মতো পুষ্টি কোনোটাতেই নাই। মারাত্মক পুষ্টি। প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট–সব এর মধ্যে আছে। ভাতের মধ্যে পানি ছাড়া আর কী আছে? বাঙালী জাতির সর্বনাশ হয়েছে ভাত খেয়ে।
নিজাম সাহেবের নিজের তিন ছেলের উপর বিশ্বাস ছিল অত্যন্ত প্রবল। তাঁর ধারণা ছিল, এরা একটা কিছু করে দাঁড়িয়ে যাবে। সেই ধারণা প্রায় ভেঙে পড়ার অবস্থা হল মেজ ছেলেকে দিয়ে।
সে বি.এস-সি পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগে হঠাৎ ঘঘাষণা করল পরীক্ষা দেবে। না, কারণ বড় পীর সাহেব আবদুল কাদের জ্বিলানি তাকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন পরীক্ষাটরীক্ষার ব্যাপারে মাথা না ঘামিয়ে আল্লাহর পথে যাওয়ার জন্য। সে স্বপ্নে বড়ো পীর সাহেবের কাছ থেকে দোয়া পেয়েছে–যা প্রতি দিন পড়তে হবে ত্রিশ হাজার বার। শুধু বৃহস্পতি বার রাতে পড়তে হবে সত্তর হাজার বার।
এর মধ্যেও নানান রকম ফ্যাকড়া দেখা দিতে লাগল। যেমন সে হঠাৎ মেয়েদের দিকে তাকান বন্ধ করে দিল। কারণ মেয়েদের দিকে তাকালে পাপ হয়। কোনো মেয়ের গলা শোনামাত্র সে দু হাতে চোখ ঢেকে ফেলত।
এইসব ক্ষেত্রে যা হয়, একটি হত-দরিদ্র পরিবারের সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে, নিজাম সাহেব ছেলের বিয়ে দিলেন। বাসার সবাই প্রায় নিশ্চিত, এইবার ছেলের মতিগতি ফিরবে। এবং ফিরলও। সে তার স্ত্রীর শাড়ি, গয়না ইত্যাদির ব্যাপারে অতিরিক্ত রকমের আগ্রহী হয়ে উঠল। দিনরাত এইসব নিয়ে বাবার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করতে লাগল। গলা ফাটিয়ে চিৎকার–এত লোক থাকতে মাজেদাকে দিয়ে সব কাজ করা হয়, এর মানে কী? এর মানে কী আমি জানতে চাই।
দু বছরে তাদের তিনটি ছেলেপূলে হল (প্রথম বার যমজ কন্যা) এবং এর পরপরই নিজাম সাহেবের মেজ ছেলে এক পৌষমাসের প্রচণ্ড শীতে বড় ভাইয়ের সঙ্গে রাগ করে মসজিদে ঘুমুতে গেল। মসজিদের ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে এক রাতের মধ্যেই কালান্তক নিউমোনিয়া বাধিয়ে ফেলল।