যাই হোক, হোট দুলাভাই প্রায়ই আমাদের বাসায় আসেন। সাধারণত রাতের বেলা খাবার সময়টায় আসেন। খাওয়াদাওয়ার পর গল্প করতে-করতে এগারটা বাজিয়ে ফেলেন। তখন আমরা আর তাকে যেতে দিই না।
বুঝলে আপা, তাকে প্রথম দেখে যেরকম গভীর মনে হয়েছিল, তিনি সে রকম নন। খুব গল্পবাজ। ফরিদা আপা তার নাম দিয়েছে মিঃ বকবকর। এই নিয়ে মা ফরিদা আপাকে খুব বকা দিয়েছে। দেখ তো মায়ের কাণ্ডকারখানা। আমরা দুলাভাইয়ের সঙ্গে কি বলি না-বলি, তার মধ্যেও তার থাকা চাই।
গত পরশুদিন রাতে একটা মজার কাণ্ড হয়েছে। বড়ো দুলাভাই তার ব্যবসার কাজে ঢাকা এসেছেন। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। বাবা বিরাট এক কাতলা মাছ কিনলেন দুশ পচাত্তর টাকা দিয়ে। সেই মাছের মাথাটা কোন জামাইকে দেবেন তা নিয়ে মা খুব চিন্তিত। গোপনে মিটিং করছেন ফরিদা আপার সঙ্গে। ঠিক করা হল, বড়ো দুলাভাইকে দেওয়া হবে।
কিন্তু কী কাণ্ড, শেষ মুহূর্তে দেখা গেল সেটা দেওয়া হয়েছে ঘোট দুলাভাইকে। বড়োপা সঙ্গে সঙ্গে মুখ কালো করে ফেলল।
ছোট দুলাভাই অবশ্যি মাছটা তুলে দিলেন বড়ো দুলাভাইকে এবং বললেন–আমি মাছের মাথা খাই না। আমার কিন্তু ধারণা, তিনি ঠিকই খান।
চিঠি পড়তে পড়তে বারবার চোখ ভিজে উঠছিল। নতুন পল্টন লাইনের সংসার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আহু, কী গভীর আনন্দ সেখানে।
মার্থা বলল, এক চিঠি তুমি ক বার করে পড়, বল তো রেবেকা? অনেক বার।
এত সময় নষ্ট কর কেন তোমরা? আমাদের মতো করতে পার না? এই দেখ না, আমার হাসবেও আমাকে কার্ড পাঠিয়েছে।
মার্থা কার্ড এগিয়ে দিল। সেখানে একটি শুকনো ধরনের লোকের ছবি। সে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। মুখে থার্মোমিটার। নিচে লেখা প্ৰিয়তমা, তোমার বিরহে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি। পাশেই এক বিশালবা নার্স। ছবিটি এ রকম, যেন বিরহটা নার্সের কারণেই বোঝায়।
কি রকম ফানি কার্ড, দেখলে? সে যা বলতে চাইছে বলা হল। রসিকতাও করা হল। সময় নষ্ট হল না। আমাকেও চিঠি লিখতে বসতে হবে না। আমিও একটা কার্ড কিনে পাঠাব। সেখানেও ফানি কিছু লেখা থাকবে।
কিন্ত সে লেখাগুলি তো অন্যের। তোমার নিজের কথা তো নয়।
সেইসব কাউই কিনবে যার লেখাগুলো তোমার নিজের লেখা বলে মনে হয়। তাহলেই হল। তাছাড়া যারা এইসব কাৰ্ড লিখছে, তারা দারুণ বুদ্ধিমান লোক। মনের ভাব এরা অনেক গুছিয়ে বলতে পারে।
তারা রাত এগারটার দিকে ঘুমুতে গেল। বাইরে ঝড়ের মাতামাতি।
অনেকক্ষণ পর্যন্ত ঘুম এল না রেবেকার। তার বারবার ইচ্ছা করতে লাগল ড. ওয়ারডিংটনের এই খবরটি পাশা নামের মানুষটিকে জানাতে।
এত রাতে টেলিফোন পেলে সে কি বিরক্ত হবে? বোধহয় হবে না। কিছু কিছু মানুষকে দেখলেই মনে হয়, এরা কখনই কোনো কারণে বিরক্ত হয় না। নাসিম সেরকম এক জন মানুষ।
মার্থাকে সঙ্গে নিয়ে তার জন্যে মজার একটা কার্ড কিনলে কেমন হয়? ফরিদা কোনট-না-কোনোভাবে সেটা চুরি করে ফেলবে। সবাইকে দেখিয়ে আরেক কাণ্ড করবে।
দেশ থেকে আসা কোনো চিঠি
দেশ থেকে আসা কোনো চিঠিই পাশা দু বার পড়ে না।
দু বার পড়ার মতো কিছু কোনো চিঠিতে থাকে না। পত্রলেখকের নাম পড়ে বলে দেওয়া যায়, কী লেখা আছে চিঠিতে।
দেশের অবস্থা ভালো না।
দেশে আসবার কথা চিন্তা করা মহা বোকামি।
এখান থেকে কাউকে গ্রীন কার্ড দেওয়া যায় কিনা দেখ।
কিছু ডলার পাঠান কি সম্ভব হবে? অত্যন্ত অসুবিধায় আছি।
এই কথাগুলিই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানান ভঙ্গিমায় লেখা থাকে। এর বাইরে যেন দেশের মানুষদের আর কিছু বলার নেই।
এবারে বড় ভাইয়ের চিঠিটা অবশ্যি একটু অন্য রকম। দীর্ঘ চিঠি। পাশা দু বার পড়ল। বহুদিন পর একটি চিঠি দু বার পড়া হল।
গত মাসে তোমার কোনো ড্রাফট পাই নাই।
অত্যন্ত চিন্তাযুক্ত আছি। মনে হয় ড্রাফটা মিসিং হয়েছে। কুন্দুস সাহেবের সঙ্গে এই বিষয়ে আলাপ হয়েছে। তারও ধারণা ড্রাফট মিসিং হয়েছে। আজকাল এ রকম প্রায়ই হয়। চোরের দেশ। পোস্টঅফিসের ফরেন অফিসের এ ব্যাপারে হাত আছে। ড্রাফট তাদের পছন্দসই লোকের হাতে চলে যায় এবং তা বিনা ঝামেলায় যথাসময়ে ভাঙান হয়। টাকা খাওয়াতে হয়। টাকার খেলা।
আমি খোঁজখবর করবার জন্যে লোক লাগিয়েছি। তোমার মনে আছে কিনা জানি না, আমার শালার এক চাচাতো ভাই জিপিওতে কাজ করেন। অফিসার র্যাঙ্ক। আমি গত বুধবার তার কাছে গিয়েছিলাম। তিনি যথেষ্ট খাতির-যত্ন করলেন এবং আমাকে বললেন, ব্যাপারটা সপ্তাহখানিকের মধ্যে দেখবেন। তবে তিনি বিশেষ করে বলে দিয়েছেন, ড্রাফটের রেজিষ্ট্রেশন নাম্বার ইত্যাদি পাঠানর জন্যে।
কাজেই তুমি আমার এই চিঠি পাওয়ামাত্র অতি অবিশ্যি ড্রাফটের রেজিষ্ট্রেশন নার পাঠাবে। সবচে ভালো হয় যদি রশিদের একটা ফটো-কপি পাঠাতে পার। কিছুমাত্র বিলম্ব করবে না। আমি অত্যন্ত চিন্তাযুক্ত আছি।
ভালো কথা, তুমি মিতার নামে যে এক শ ডলার পাঠিয়েছ, তা সে পেয়েছে। এতগুলি টাকা ওদেরকে পাঠানর কী কারণ বুঝলাম না। বিয়ের পর আমি সাড়ে তিন শত টাকা দিয়ে একটা মেরুন কালারের জামদানি শাড়ি দিয়েছি। আমার দেওয়া মানেই তোমার দেওয়া। কাজেই এইখানে আলাদা করে এতগুলি টাকা পাঠানর কোনো কারণ দেখি না।
যদি মনে কর এইভাবে দরিদ্র আত্মীয়স্বজনকে সাহায্য করবে তাহলে ভুল করবে। সেটা সম্ভব না। এক জনকে কিছু দিলেই সবাই ছেকে ধরবে। তুমি কত জনকে দেবে?