ড. রেলিং কুইজের কাগজপত্র দিয়ে দিলেন। বারবার রুমাল চোখের উপর চেপে ধরে প্রশ্নের উত্তর লিখল রেবেকা।
সুন্দরভাবে যেদিনটি শুরু হয়েছিল, কী কুৎসিতভাবেই না তা শেষ হচ্ছে।
বাড়ি থেকে আসা চিঠিটা অনেক মোটা। অনেকগুলি বাড়তি টিকিট সেখানে। সেই চিঠিও খুলে পড়তে ইচ্ছা করছে না। রেবেকা তার চব্বিশ বছরের জীবনে এত লজ্জিত, এত অপমানিত বোধ করে নি। কুইজ জমা দেবার সময় ড. রেলিং বললেন, রেবেকা, আজ বিকেলে আমার সঙ্গে এক কাপ কফি খাওয়ার সময় কি তোমার হবে?
হবে, স্যার।
বেশ, মেমোরিয়াল ইউনিয়নে চলে আসবে। ক্লাস শেষ করেই চলে আসবে। পরীক্ষা মেন দিলে?
ভালো।
কেমন ভালো? বেশ ভালো?
হ্যাঁ, বেশ ভালো।
তুমি বেশ স্মার্ট মেয়ে। আই লাইক ইউ।
রেবেকা কিছু বলল না। কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল, কিছুই ভালো লাগছে না। এমন কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে আরেক বার কেঁদে ফেলবে।
মেমোরিয়েল ইউনিয়ন ফাঁকা। আবহাওয়ার অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। প্রচুর তুষারপাত হচ্ছে। রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনা। সবাই বাড়ি চলে যাচ্ছে তাড়াহুড়ো করে। ড. রেলিং বিরাট এক কাপভর্তি কফি এবং দুটো ডোনাট নিয়ে বসে আছেন। রেবেকা তার সামনে এসে বলল।
কই, তোমার কফি কোথায়?
আমি কফি খাই না, স্যার।
অন্য কিছু খাও। চা খাও।
আমার স্যার খেতে ইচ্ছা করছে না।
কথায় কথায় স্যার বলছ কেন তুমি? তোমাকে তো আগেই বলেছি, আমাকে নাম ধরে ডাকবে।
রেবেকা কিছু বলল না। ড. রেলিং কফির কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে বললেন, আজ তুমি কিছুটা অপমানিত বোধ করেছ বলে আমার ধারণা। আমি তার একটি প্রধান কারণ। তার জন্যে তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। কাউকে অপদস্থ করা আমার পেশা নয়। তবে রেবেকা, কোনো ব্যাপারেই এত সেনসিটিভ হওয়া ঠিক না। বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত দরিদ্র দেশ, এটা তুমি নিজেও খুব ভালো করে জান। আমরা সবাই জানি। জানা সত্তেও দেশকে দরিদ্র বললে তুমি একটা শিশুর মতো আচরণ করবে এটা ঠিক না। এই ইউনিভার্সিটিতে অনেক আগে একটি বাংলাদেশী আণ্ডারগ্রাজুয়েট ছাত্র তোমার মতোই শিশুসুলভ আচরণ করেছিল। তার দেশ সম্পর্কে কে যেন কী বলেছে, সে ঘুষি মেরে তার দুটি দাঁত ভেঙে ফেলেছে। পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছিল ব্যাপারটা।
ড. রেলিং দম নেয়ার জন্যে থামলেন। রেবেকা কী বলবে বুঝতে পারল না। ড. রেলিং গম্ভীর গলায় বলতে লাগলেন, আমি স্বীকার করলাম, তোমরা তোমাদের দেশকে দারুণ ভালোবাস। অথচ আমি যত দূর জানি, তোমাদের দেশে সামরিক শাসন চালু আছে। যে-দেশের মানুষ তার দেশকে এত ভালোবাসে, তারা কী করে সামরিক শাসন চুপচাপ মেনে নেয়। এবং আমি শুনেছি, যে-ব্যক্তিটি তোমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল নায়ক, তাকে সপরিবারে মেরে ফেলা হয়েছে এবং কেউ একটা কথাও বলে নি। আমি যা বলছি তা কি সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি।
তোমাদের দেশের প্রতি যে ভালোবাসা তা কেমন ভালোবাসা, বল তো রেবেকা?
রেবেকা চুপ করে রইল।
চল, ওঠা যাক। আবহাওয়ার অবস্থা ভালো নয়। যে-হারে বরফ পড়ছে, তাতে মনে হয় আগামীকাল রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে যাবে। উইকএণ্ড শুরু হবে এক দিন আগে। তুষারপাতের দৃশ্যটি তোমার কাছে কেমন লাগে রেবেকা?
অপূর্ব!
তোমার দেশে এত সুন্দর দৃশ্য কি আছে?
আমাদের দেশের বৃষ্টিও খুব সুন্দর।
তবুও তোমার দেশই থাকবে শ্ৰেষ্ঠ? হা-হা-হা।
রেবেকাও হাসতে থাকল। তার মনের গ্লানি কেটে যেতে শুরু করেছে। কী অপূর্ব একটি দৃশ্য বাইরে। লক্ষ লক্ষ শিমূল গাছের তুলেবিচি হঠাৎ করে যেন ফেটে গেছে।
শিশুদের দল রাস্তায় নেমে গেছে। বরফের বল বানিয়ে এক জন অন্য জনের গায়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে। বল যার গায়ে লাগছে, সে যথেষ্ট ব্যথা পাচ্ছে বলেই মনে। হয়। কিন্তু কাঁদছে না।
কিছুক্ষণ পরপর সবাই মিলে নরম বরফে গড়াগড়ি করছে। ড. রেলিং বললেন, এই জাতীয় কোন দৃশ্য কি আছে তোমাদের দেশে? এরকম গড়াগড়ি করার দৃশ্য?
রেবেকা হাসিমুখে বলল, উৎসবটুৎসব উপলক্ষে মাঝে মাঝে মাটিতে পানি ঢেলে কাদা তৈরি করা হয়, তারপর সবাই মিলে সেই কাদায় গড়াগড়ি করে।
সেই দৃশ্যটি এত সুন্দর?
না, এত সুন্দর না।
যাক, তাহলে একটি দিকে আমরা জিতে রইলাম।
ড. রেলিংগলা ফাটিয়ে হাসতে লাগলেন। রেবেকাও হাসতে শুরু করল। এখন তার চমৎকার লাগছে।
রাত নটার মধ্যে এক ফুট বরফ পড়ল। আবহাওয়া দফতর বলল, বাকি রাতে আরোদু ফুটের মতোবরফ পড়তে পারে। তুষারঝড়ের একটা আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। ঘন্টায় পঞ্চাশ থেকে সত্তর কিলোমিটার বেগে গাস্টি উইণ্ড হবার কথা। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কাউকে বের না হবার পরামর্শ দেওয়া হল।
রেবেকা সকাল-সকাল শুয়ে পড়ল। টেবিল-ল্যাম্প জ্বালিয়ে খাম খুলল। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, চিঠিটার কথা তার মনেই ছিল না। ঘুমুতে যাবার আগমুহূর্তে মনে পড়েছে। চিঠি লিখেছে টুটুল। টুটুল এত গুছিয়ে লিখতে পারে, তা রেবেকা কল্পনাও করে নি।
ছোট আপা,
কেমন আছ তুমি?
সবাইকে বড়ো বড়ো চিঠি লিখেছ, কিন্তু আমার কাছে মাত্র তিন লাইনের নোট। আমি কী দোষ করলাম? আমি অনেক চিন্তা করে নিজের একটা দোষ খুঁজে পেয়েছি। এয়ারপোর্টে তোমাকে বিদায় দিতে এসে সবাই কাদছিল, শুধু আমি কাদি নি। এই জন্যেই কি আমাকে ছোট চিঠি?
কিন্তু হোট দুলাভাইও তো কাঁদেন নি। তাকে তুমি ঠিকই লম্বা- চিঠি লিখছ। এর মধ্যে তাকে তিনটি চিঠি লিখে ফেলেছ। তার মধ্যে একটি চিঠি ফরিদা আপা চুরি করে নিয়ে এসেছে। এবং সবাই পড়েছে। এমন কি মা-ও পড়েছে। সেই চিঠি নিয়ে খুব হাসাহাসি হয়েছে। ছোট দুলাভাই ফরিদা আপার ওপর খুব রাগ করেছেন।