লুসি চোখ নাচাল। ওয়ারডিংটন বললেন, এই মেয়ের হাতের ডিজাইনের কথাই বলছিলাম। বিয়ের সময় এরা হাতে এই ডিজাইন করে। রেবেকা হাত মেলে ধর।
রেবেকা হাত মেলে ধরল। লুসি তীক্ষ চোখে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। তার মধ্যে তেমন কোনো উৎসাহ দেখা গেল না।
লুসি, তুমি ছবি তুলবে বলছিলে। ছবি তোল।
লুসি নিতান্ত অনিচ্ছাতেই ছবি তুলতে গেল। যেন তার নিজের কোন ইচ্ছা নেই। নেহায়েতই স্বামীকে খুশি করা। রেবেকার মন খারাপ হয়ে গেল। এক জন বুড়ি মুখ ব্যাজার করে তার ছবি তুলছে–দৃশ্যটি সুখের নয়।
বুঝলে লুসি, এরা বিশ্বাস করে, এই ডিজাইন যত বেশি দিন থাকে, এরা বিবাহিত জীবনে ততই সুখী হয়।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, এই মেয়েটির হাতে অনেক দিন ধরে আছে। এ খুব সুখী মেয়ে। তাই না রেবেকা?
রেবেকা বলল, আমি কি এখন যেতে পারি স্যার?
না, পার না। চেয়ারটায় বস। কথা আছে তোমার সঙ্গে।
রেবেকা বসল।
ওয়ারডিংটন হাসিমুখে বললেন, তুমি কি ইউনিভার্সিটিতে পি-এইচ, ডি প্রোগ্রামের ব্যাপারে উৎসাহী?
রেবেকা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
আমি তোমার কথা ফ্যাকাল্টিতে আলাপ করেছি। তুমি যদি উৎসাহী হও তাহলে তোমাকে গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট হিসেবে নেওয়া যাবে।
রেবেকা কী বলবে ভেবে পেল না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। কিন্তু আমার নিজের কাছে একটি ফাণ্ড আছে। মাকো তেল কোম্পানির ফাণ্ড। সেখান থেকে তোমাকে আমি রিসার্চ স্টুডেন্ট হিসেবে গ্রান্ট দিতে প্রস্তুত আছি। তুমি ভেবেটেবে আমাকে বলবে। অবশ্যি খুব একটা সময়ও হাতে নেই। স্প্রিং কোয়ার্টারে এনরোল্ড হতে হলে কয়েক দিনের মধ্যেই তোমাকে এ্যাপ্লাই করতে হবে।
রেবেকা বসে-বসে ঘামতে লাগল। বলে কি এই বুডো? সে করবে পি-এইচ. ডি? যার অনার্স এবং এম. এস-সি দুটোতেই সেকেণ্ড ক্লাস, তাও শেষের দিকে।
শোন রেবেকা, আমার মনে হয় না তোমার সরকার বা তোমার অফিস এতে কোনো আপত্তি করবে। বিনে পয়সায় তারা এক জনকে ট্ৰেইণ্ড করতে পারছে। ঠিক না?
জি-স্যার, ঠিক।
আমি যদি রেবেকা হতাম, তাহলে খুব খুশি হয়েই রাজি হতাম। এটা আমার মনে হয় বেশ একটা ভালো সুযোগ।
স্যার, আমি রাজি।
এখনই রাজি হবার দরকার নেই, তুমি ভেবে দেখা সময় আছে।
প্রফেসর ওয়ারডিংটন ড্রয়ার খুলে কিছু ফরম্ বের করলেন।
তোমার জন্যে ফরম্ আনিয়ে রেখেছি। মনস্থির করে এগুলো ফিলআপ করবে। তোমার সঙ্গে সার্টিফিকেটগুলো কি আছে?
জ্বিনা স্যার। ঐসব তো আনি নি।
সার্টিফিকেটগুলোর ফটোকপি নিশ্চয়ই আছে। তোমার কাছে না থাকলেও আমাদের কাছে আছে। শর্ট কোর্সে এনরোল্ড হবার আগে তোমাকে এসব পাঠাতে হয়েছে। কাজেই সার্টিফিকেটের কপি যোগাড় করতে কোনো অসুবিধা নেই।
রেবেকা চুপ করে রইল।
আমার উৎসাহ দেখে তুমি আবার ভাবছ না তো যে, তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই। আমার স্ত্রীকে তো দেখছ, শক্ত মহিলা। হা-হা-হা! কি লুসি, ঠিক বলছি না?
লুসি হাই তুলল। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এ ধরনের কথাবার্তায় তার কোনো উৎসাহ নেই।
রেবেকা বলল, স্যার, আমি এবার আসি?
ঠিক আছে, যাও।
বুড়িটিকেও এখন আর খারাপ লাগছে না। ভালোই লাগছে। বুড়ি তার দিকে হাত বাড়াল।
গুড লাক, রেবেকা।
থ্যাঙ্ক ইউ।
বুড়ি রেবেকা উচ্চারণ করল খুব পরিষ্কারভারে, অবিকল বাঙালী মেয়েদের মতো।
ছবি ডেভেলপ করলেই তোমাকে পাঠান হবে।
রেবেকা দ্বিতীয় বার বলল, থ্যাঙ্ক ইউ।
বাকি দিনটা কাটল উত্তেজনার মধ্যে। ম্যাট্রিক পরীক্ষা শুরু হবার ঠিক আগের কয়েক ঘন্টা যেরকম লাগে সেরকম কোনো কিছুতেই মন বসছে না। সব কিছুই কেমন অস্পষ্ট, ছাড়া-ছাড়া, বুকের মধ্যে একটা চাপা ব্যথাবোধ।
মেইল বক্সে চিঠি আছে। দেশের চিঠি। খামের ওপরের লেখা দেখে মনে হয় টুটুলের লেখা। কিন্তু কেন যেন খুলে দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে না। আরিয়ে রত্মা এক বার জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে তোমার? সে আরিয়ে রত্নাকে কিছু বলল না। ড. রেলিংএর ফুড পয়জনিংয়ের লেকচারের কিছুই তার মাথায় ঢুকল না। শুধু আবদুল্লাহ্ যখন উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ফুড পয়জনিং দরিদ্র দেশে হয় না। কারণ দরিদ্র দেশে ফুডই নেই। দরিদ্র দেশের মানুষ যা খায়, সবই হজম করে ফেলে। হা-হা- হ্যাঁ। তখন রেবেকা খানিকটা সচেতন হল। কারণ ড. রেলিং তার দিকে তাকিয়ে আছেন।
রেবেকা, দরিদ্র দেশের প্রতিনিধি হিসেবে এ প্রসঙ্গে তোমার মতামত কী?
রেবেকা চোখমুখ লাল করে বলল, বাংলাদেশ দরিদ্র দেশ নয়।
বেশ বড় রকমের একটা হাসির হল্লা উঠল চারিদিকে। রেবেকা দাঁড়িয়েই রইল। হাসির কারণ সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে না। ড. রেলিং বললেন, বেশ, তুমি তাহলে একটি ধনী দেশের প্রতিনিধি হিসেবেই তোমার মতামতটা বল।
আবার একটা হাসির হল্লা। ড. রেলিং নিজেও হাসছেন। রেবেকার চোখের সামনে হঠাৎ সব ঝাপসা হয়ে উঠতে শুরু করল। সে বুঝতে পারছে, এখন আর তার কিছু করার নেই। চোখের পানি আটকাবার আর কোনো পথ নেই।
সমস্ত ক্লাস নিঃশব্দ। ড. রেলিং হতভম্ব। সামান্য রসিকতায় একটি বয়স্ক মেয়ে এইভাবে কাঁদতে পারে তা তিনি কল্পনাও করেন নি।
মি ইন হাত ধরে রেবেকাকে বসাল। রুমাল এগিয়ে দিল তার দিকে। এই ছোটখাট মেয়েটি কখনোই ক্লাসে কোনো কথাবার্তা বলে না। গুছিয়ে কিছু বলার মতো ইংরেজি জ্ঞানও তার নেই। কিন্তু সে শান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে চমৎকার ইংরেজিতে বলল, চীন দেশ এক সময় দরিদ্র ছিল। সবাই হাসাহাসি করত মহান চীনকে নিয়ে। তাতে মহাচীনের কোনো ক্ষতি হয় নি। একটি দেশ যতই দরিদ্র হোক, তাকে নিয়ে রসিকতা করার স্পৰ্ধা কারোর থাকা উচিত নয়।