ভদ্রলোক একটা কালো ব্যাগ খুলে লাল রংয়ের একটা কলম বের করলেন। কলমের ভেতর ব্যাটারি লাগান, সুইচ টিপলেই আলো বের হয়। সেই আশোয় অন্ধকারে লেখা যায়।
এই কলমটা নাও রেবেকা। আরে বোকা মেয়ে, এত লজ্জা কিসের! নাও নাও। আর শোন, তুমি কাল এক বার আসবে, তোমার ছবি তুলব। আসবে কিন্তু।
রেবেকা গিয়েছিল। ভদ্রলোক ছিলেন না। পরে সে আরো অনেক বার গিয়েছে, কোনো বারই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় নি। তিনি মাত্র এক সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন। দারুণ ব্যস্ততার মধ্যে তাঁর সময় কাটছিল।
সুরাইয়ার কাছে যেদিন শুনল বদি চাচা চলে গেছেন, এমন মন খারাপ হল তার। বেশ মনে আছে, সে টিফিন পিরিয়ডে খানিকক্ষণ কেঁদেছিল।
পাশা চৌধুরীর সঙ্গে সুরাইয়ার চাচার চেহারায় কোথায় যেন একটা মিল আছে। মিলটি কোথায় রেবেকা ধরতে পারল না। তার কেমন জানি অস্বস্তি লাগতে লাগল। যেন মিল থাকাটা ঠিক নয়।
রিনরিন শব্দে কলিং-বেল বাজছে। দুটি ব্রাউন পেপার ব্যাগ হাতে পাশা দাঁড়িয়ে আছে। তার সারা গায়ে বরফ। খুব বরফ পড়ছে বাইরে।
আমার রান্না কেমন তা তো বলছেন না, শুধু খেয়েই যাচ্ছেন।
খুব ভালো রান্না। চমৎকার রান্না।
কাঁচা মরিচ পেলে আরো ভালো হত। কাঁচা মরিচ পাওয়া যায় না এদেশে, তাই না?
পাওয়া যায়। মেক্সিকো থেকে আসে। আমার কিনতে মনে ছিল না। পরের বার কিনব।
হাত ধুতে-ধুতে রেবেকা নিচুস্বরে বলল, আপনি যখন ছিলেন না, তখন আমি একটা অন্যায় করেছি। ভেবেছিলাম আপনাকে বলব না। কিন্তু না বললে আমার খারাপ লাগবে।
পাশা অবাক হয়ে বলল, কী অন্যায়? রাগ করার মতো অন্যায় করার এখানে কোন সুযোগ তোমার নেই। ব্যাপারটা কী বল।
রেবেকা চোখমুখ লাল করে বলল, দেশ থেকে আপনার যে চিঠিগুলো এসেছে, সেগুলো পড়ে ফেলেছি।
পাশা শব্দ করে হাসল।
হাসছেন কেন?
হাসি আসছে তাই হাসছি। তুমি বেশ অদ্ভুত মেয়ে তো রেবেকা।
মজার কী দেখলেন আপনি?
পাশা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, চিঠিগুলো পড়তে কেমন লাগল?
আপনার ভাইয়ের চিঠিটা খুব মজার।
গত পনের বছর ধরে এই রকম চিঠি পাচ্ছি, একই ভাষা, একই বক্তব্য। তবে এবার ভাষা বা বক্তব্য দুটোই বদলাবে।
কেন?
টাকা পাঠান হয় নি।
পাঠান নি কেন?
আমার একটা দুঃসময় যাচ্ছে।
কী দুঃসময়?
আমি কোনো চাকরিবাকরি করি না। ভিডিও গেম-এর সফটঅয়ার তৈরি করে বিক্রি করি। বেশ কিছু দিন ধরে কিছু বিক্রি করতে পারছি না।
রেবেকা বিস্মিত হয়ে বলল, আপনি কী করেন আমি বুঝতে পারলাম না।
অন্য এক দিন বুঝিয়ে দেব।
আজকে বোঝাতে আপনার অসুবিধাটা কী?
না, কোনো অসুবিধা নেই।
আপনার ধারণা আমি খুব বোকা মেয়ে?
না, সেরকম ধারণা হবে কেন?
জানেন, আমি সব কটি পরীক্ষায় সবার চেয়ে বেশি নম্বর পাচ্ছি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। প্রফেসর ওয়ারডিংটন আমাকে কী বলেছেন শুনতে চান?
শুনতে চাই।
প্রফেসর ওয়ারডিংটন বলেছেন–আমার মতো ইন্টেলিজেন্ট মেয়ে তিনি খুব কম দেখেছেন। কি, আমার কথা বিশ্বাস হল না?
বিশ্বাস হবে না কেন?
তাহলে আপনি এমন মুখ টিপে হাসছেন কেন?
আর হাসব না।
বাইরে গাড়ি হন দিচ্ছে। মাৰ্থা এসে গেছে। রেবেকা কোট গায়ে দিতে-দিতে বলল, আসছে উইকণ্ডে আপনি নিজে গিয়ে যদি আমাকে না আনেন, তাহলে কিন্তু আমি আসব না।
আমি নিজে গিয়েই আনব।
চারটার সময় আমাদের ক্লাস শেষ হয়। আপনি অবশ্যই পাঁচটার মধ্যে চলে আসবেন।
আসব। পাঁচটার মধ্যেই আসব।
আর, অনেকক্ষণ বকবক করলাম, কিছু মনে করবেন না।
ঠিক আছে, মনে করব না।
পাশা তাকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেল। গুঁড়িগুঁড়ি তুষার পড়ছে। রেবেকা অবাক হয়ে বলল, বরফ পড়ছে, তাই না?
হ্যাঁ।
কী সুন্দর।
পাশা সহজ স্বরে বলল, আমেরিকার এই একটি জিনিসই সুন্দর।
রেবেকা পা ফেলছে খুব সাবধানে। প্রথম রাতেই পাশা তাকে যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছিল, ঠিক সেইভাবে। প্রথমে গোড়ালি। তারপরে পা।
সারারাত ধরে তুষারপাত হল। ছ ইঞ্চি বরফে ঢেকে গেল ফাগো শহর। এক রাতের ভেতর তাপমাত্রা নেমে গেল শূন্যের পনের ডিগ্রী নিচে। ক্রিসেন্ট লেকের পানি জমে যেতে শুরু করল। ফাগগাবাসী আনন্দে উৎফুল্ল হল। হোয়াইট ক্রিসমাস হবে এবার। এর আগের বছর ক্রিসমাসের সময় কোনো বরফ ছিল না। আচমকা খানিকটা গরমে সমস্ত বরফ গলে প্যাচপ্যাচে কাদা হয়ে গিয়েছিল। এরা বলে ইণ্ডিয়ান সামার। কেন বলে কে জানে?
প্রফেসর ওয়ারাডিংটন
প্রফেসর ওয়ারাডিংটন বললেন, রেবেকা, লাঞ্চ-ব্রেকের সময় তুমি কি আমার ঘরে এক বার আসবে?
ওয়ারডিংটনের মুখে মিটিমিটি হাসি। যেন রহস্যময় কোন ব্যাপার আছে তাঁর ঘরে।
এক জন অপেক্ষা করবে তোমার জন্যে।
কে?
তা বলব না। সে তোমার জন্যে একটা সারপ্রাইজ হিসাবেই থাক। আগেভাগে কিছু বলতে চাই না।
লাঞ্চ-ব্রেক পর্যন্ত আবোলবোল অনেক কিছু ভাবল রেবেকা। এমনকি এক বার কল্পনা করল, নাসিম এসে বসে আছে। যেন কোনো অদ্ভুত উপায়ে ব্যবস্থা করে চলে এসেছে। সে ঢুকে দেখবে ঘিয়ে পাঞ্জাবি-পরা একটি মানুষ, যার কথাবার্তা আশ্চর্য রকমের কোমল এবং যে কিছুক্ষণ পরপরই টেবিলে আঙুল দিয়ে ঠক ঠক ঠক করে। এই অভভ্যসটি সে কোত্থেকে জুটিয়েছে কে জানে!
ওয়ারডিংটনের ঘরে ষাট বছর বয়েসী এক বুড়ি বসে ছিল। তার গায়ে দারুণ চকমকে পোশাক। ঠোঁটে কড়া মেরুন রঙের লিপস্টিক। সে বিরক্ত মুখে ক্ৰমাগত সিগারেট টানছে।
ওয়ারডিংটন বললেন, পরিচয় করিয়ে দিই–এ হচ্ছে লুসি, আমার স্ত্রী। এঁর কথাই তোমাকে বলছিলাম। আর এই মেয়েটি রেবেকা। বাংলাদেশ থেকে এসেছে।