রেবেকা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আপনাকে আমি কী বলে ডাকি, বলুন তো? প্রথম যেদিন আপনার সঙ্গে দেখা, তখন মনে হয়েছিল ছোটমামার মত। মুখের নিচের দিকটা।
ছোটমামা ডাকতে পার।
কিন্তু এখন আপনাকে ছোটমামার মত লাগছে না। খুব এক জন চেনা লোকের মতো লাগছে। সেই চেনা লোকটি কে, ধরতে পারছি না।
পাশা নরম স্বরে বলল, বিদেশে এ রকম হয়। যে কোনো বাঙালী দেখলেই মনে হয় চেনা। পরিচিত কারো চেহারার সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। আসলে অবশ্যি তেমন কোন মিল থাকে না।
কিন্তু আপনার চেহারার সঙ্গে এক জন লোকের চেহারার সত্যি-সত্যি মিল আছে। আমি মনে করতে চেষ্টা করছি। মনে পড়লেই বলব। আপনি ছাড়া এখানে আর কোনো বাঙালী নেই?
করিম সাহেব ছিলেন। এখন নেই, সপরিবারে শিকাগো গিয়েছেন, স্প্রিং-এ ফিরবেন। স্প্রিং পর্যন্ত তুমি যদি থাক, তাহলে তাঁর সঙ্গে দেখা হবে।
রেবেকার শীত লাগছিল। ঘরটা বোধহয় সেরকম গরম নয়। সে গ্যাসের চুলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আগুনের ওপর হাত মেলে বলল, শুনুন, দশটার সময় আমার বান্ধবী আমাকে নিতে আসবে। ও গিয়েছে কোন এক পাবে। ফেরার পথে সে আমাকে নিয়ে যাবে। কাজেই দশটা পর্যন্ত আমি অনবরত বাংলায় কথা বলব। আপনি রাগ করতে পারবেন না। আর আমি আপনার এখানে ভাত খাব। গত এক সপ্তাহ ধরে ভেবে রেখেছি, আপনার এখানে ভাত খাব।
মুশকিলে ফেললে, ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা তো এখানে নেই।
সে কি! আপনি ভাত খান না?
ভাত খাব না কেন? ভাত খাই, তবে রান্নটান্নার অনেক ঝামেলা, কাজেই ঐ ঝামেলাতে যাই না।
বলেন কি আপনি!
রেবেকা সত্যিকার অর্থেই নিভে গেল।
আপনি ভাত খান না, এটা জানলে আমি সন্ধ্যেবেলায় আসতাম না।
তুমি ভাত খাবার জন্যেই এসেছ?
হ্যাঁ। আপনি রাগ করেন আর যাই করেন, আমি সত্যি কথাটা বলে ফেললাম।
পাশা উঠে দাঁড়াল। পাকা গায়ে দিতে-দিতে বলল, তুমি বস, আমি ব্যবস্থা। করছি।
কী ব্যবস্থা করবেন?
পাঁচ ব্লক দূরে একটা গ্রোসারি শপ আছে। চাল পাওয়া যায়। এক প্যাকেট চাল নিয়ে আসব। ভাত এবং মুরগির মাংস। তুমি রাঁধতে পার?
খুব পারি। আমিও তো আসছি আপনার সঙ্গে?
না, তুমি থাক। আমার গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। হেঁটে যেতে হবে।
আপনার কি ধারণা, আমি হাঁটতে পারি না?
নিশ্চয়ই পার। কিন্তু বাইরে অসম্ভব ঠাণ্ডা। তোমার অভ্যেস নেই। ঠাণ্ডা লেগে যাবে। আমার খুব দেরি হবে না। একা-একা তোমার আবার ভয় লাগবে না তো?
আমার এত ভয়টয় নেই। ভয় থাকলে একা-একা এত দূর আসতাম?
মেয়েটি তাকিয়ে আছে হাসিমুখে। ভারি সুন্দর লাগছে তো মেয়েটিকৈ! লিকুইড আইজ কি এই চোখকে বলে? ঐ রাতে মেয়েটিকে এত সুন্দর লাগে নি কেন? একটি মেয়ে কখনো রূপবতী, কখনো নয়-এরকম তো হতে পারে না। যে সুন্দর, সে সব সময়ই সুন্দর।
রেবেকা বলল, এমন করে তাকিয়ে আছেন কেন?
পাশা লজ্জা পেয়ে গেল। বিব্রত স্বরে বলল, দরজা বন্ধ করে দাও। আরেক কাপ চা বানিয়ে খাও। ফ্রীজে পনির আছে, পনির খেতে পার। আমার দেরি হবে না।
একা-একা রেবেকার খানিকটা ভয় লাগতে লাগল। এ বাড়ির হিটিং-এ কোনো গণ্ডগোল আছে। বেশ শব্দ করে গরম বাতাস আসতে থাকে। শব্দটা ভয় ধরিয়ে দেয়।
রেবেকা ফ্ৰীজ খুলল-খালি ফ্রীজ। এক টুকরো পনির পড়ে আছে। কাগজের প্যাকেটে দুধ। মাল্টার মত কয়েকটা ফল শুকিয়ে দড়ি-দড়ি হয়ে আছে।
সে চায়ের পানি চাপাল। চা খেতে ইচ্ছা করছে না। চুপচাপ বসে থাকার চেয়ে কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকা। ঘরে অনেক বই দেখা যাচ্ছে, একটিও বাংলা বই নয়। ভদ্রলোক সম্ভবত অনেক দিন ধরে এদেশে আছেন। জিজ্ঞেস করা হয় নি। এটা বেশ আশ্চর্য যে, রেবেকা তার সম্পর্কে কিছু জানতে চায় নি। ভদ্রলোকও কিছু জানতে চান নি। দু জন সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ খুব স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলছে।
বড়োখালু বলে দিয়েছিলেন–এক বার গিয়ে পৌঁছাতে পারলে গাদাগাদা বাঙালী পাবি। দেখবি এরা কত হেল্পফুল। বিদেশে বাঙালীতে-বাঙালীতে খাতির অন্য জিনিস। এক জনের জন্য অন্য জন জান দিয়ে দেবে।
পানি ফুটতে শুরু করেছে, রেবেকা এগিয়ে গেল। আর ঠিক তখন বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়ল এই লোকটির চেহারা সুরাইয়ার বড়োচাচা বদিউজ্জামান সাহেবের মত। সুরাইয়া তাঁকে ডাকত বদি চাচা।
ক্লাস ফোরে সুরাইয়া তাদের সঙ্গে ভর্তি হয়। এবং প্রথম দিনেই খাতির হয়ে যায় রেবেকার সঙ্গে। যা কথা বলতে পারে মেয়েটা, গুজগুজ ফুসফুস করছে সবার সঙ্গে। এক মুহূর্তের বিশ্রাম নেই। সেই কথাবার্তার বেশির ভাগই হচ্ছে বদি চাচাকে নিয়ে-যিনি জার্মানীতে থাকেন, যাঁর একটি জার্মান বউ আছে। অবিকল রাজকন্যার মত দেখতে। যার বড়ো ছেলের নাম পল, যে একটুও বাংলা জানে না। এক বার দেশে এসে তেলাপোকা উড়তে দেখে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। বদি চাচার গল্পের কোনো শেষ নেই।
সেই বদি চাচা এক বার দেশে বেড়াতে এলেন। রেবেকা বন্ধুর বাড়িতে তাঁকে দেখতে গেল। ভদ্রলোক সুরাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর বন্ধু? এরকম লজ্জা পাচ্ছে কেন? উকি দিচ্ছে কেন পর্দার আড়াল থেকে? এই মেয়ে, ভেতরে আস।
রেবেকা ভেতরে এসে দাঁড়াল। ভদ্রলোক বললেন, আরে, এ তো বড়ো সুন্দর মেয়ে! শ্যামলা রঙের মধ্যে এত সুন্দর কোনো মেয়ে তো আর্মি জীবনে দেখি নি। কী নাম তোমার খুকি?
রেবেকা।
বাহ্, নামও তো খুব সুন্দর। এস, আমার কাছে এসে বস। এত লজ্জা কেন তোমার, খুকি?