তৃতীয় এবং শেষ চিঠিটি বড়োভাইয়ের। তিনি প্রতি মাসে টাকা পাওয়ার পর একটি চিঠি লেখেন, এবং সেখানে টাকাপয়সা ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপার থাকে না। তাঁর চিঠি অনেকটা অফিসিয়াল চিঠির মতো।
তোমার ড্রাফট পেয়েছি। ডলারের বাজার এখন একটু ভালো। প্রতি ডলারে সাতাশ টাকা পঞ্চাশ পয়সা করে পেলাম। গতবার দর ছিল ছাৰিশ টাকা। তবে শোনা যাচ্ছে, দর এরকম থাকবে না। আমার এক জন পরিচিত এজেন্ট ২৭৮
আছে–কুন্দুস সাহেব। চাঁদপুরে বাড়ি। তিনি আমাকে সব সময় ভিতরের খবর দেন। তিনি বললেন, বাজারে বর্তমানে জার্মান মার্কের অবস্থা ভালো। ডলার এবং পাউণ্ড দুইটির দামই ভবিষ্যতে কমবে। বাসার আর সব খবর ভালো। তোমার খবর জানাবে। গত মাসে কোনো চিঠিপত্র না পেয়ে চিন্তিত আছি। রোজার মাসে কিছু বেশি পাঠাতে পার কিনা দেখবে। তোমার ভাবীর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।
বড়ো ভাইয়ের প্রতিটি চিঠির শেষ লাইন তোমার আবীর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। পনের বছর ধরে এক জন মহিলার শরীর ভালো যায় না কীভাবে সে এক রহস্য।
এবার বড়ো ভাই কী লিখবেন কে জানে? এবারই তাঁকে কোনো টাকা পাঠান হয় নি। মা-র মৃত্যুর পর তিনি একটু ভয় পেয়েছিলেন। তার ধারণা হয়েছিল, হয়ত আমেরিকা থেকে ডলার আসা বন্ধ হয়ে যাবে। সেই এক বারই তিনি তিন পাতার এক দীর্ঘ চিঠি লিখলেন। সেখানে মার পেছনে শেষের দিকে কীভাবে জলের মত টাকা খরচ হয়েছে, তার বর্ণনা আছে। তিনি যে শেষ পর্যন্ত ছ হাজার টাকা কৰ্জ করলেন, সেই কথাও আছে। ইউনিভার্সিটিতে মেয়ে ভর্তি হয়েছে, তার রিকশা ভাড়াই মাসে যে দু শ টাকা–সেই কথাও আছে।
পাশা যথারীতি ড্রাফট পাঠিয়ে বড়ো ভাইয়ের আশঙ্কা দূর করে। বাকি চিঠিগুলো পড়তে ইচ্ছে করছে না। জরুরী কোনো কিছুই নয়।
আমেরিকায় তাকে জরুরী চিঠি লেখার কেউ নেই। খিদে লাগছে। ঘরে খাবার আয়োজন তেমন কিছু নেই। পনির এবং রুটি আছে। স্যাণ্ডউইচ বানান যায়। সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। উঠতে হবে, পনির কাটতে হবে, রুটি গরম করতে হবে। পিৎসা হাটে একটা মিডিয়াম সাইজের পিৎসার অর্ডার দেওয়া যেতে পারে। কেন জানি সেই কষ্টটাও করতে ইচ্ছা করছে না।
ঘরের হিটিং কি কাজ করছে না। কেমন যেন ঠাণ্ডাঠাণ্ডা লাগছে। নাকি সত্যি সত্যি বরফ-যুগ এসে যাচ্ছে। পাশা চাদর টেনে দিয়ে চোখ বন্ধ করল। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যাবেলায়। কে যেন কলিং বেল টিপছে।
পাশা দরজা খুলে দেখল, রেবেকা দাঁড়িয়ে আছে। মুখ শুকনো। শীতে সে কাঁপছে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে কি?
রেবেকা কাঁপা গলায় বলল
রেবেকা কাঁপা গলায় বলল, আমি ভেবেছিলাম বাসায় কেউ নেই। যা ভয় পেয়েছিলাম! একা-একা কীভাবে ফিরব, তাই ভাবছিলাম।
মাৰ্থা নামিয়ে গেছে। ওকে ঠিকানা বলতেই সে চিনল। মাৰ্থা আমার রুমমেট। বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকব নাকি? ভেতরে আসতে বলুন।
ভেতরে এস রেবেকা।
রেবেকা হাসিমুখে ভেতরে ঢুকল। ওভারকোটের পকেট থেকে হাত বের করল। হাত নীল হয়ে আছে। কোনো গ্লাভস নেই হাতে।
আপনি এত অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন?
শীতের দেশে এরকম হুট করে আসা ঠিক না। আমি নাও থাকতে পারতাম। তখন ফিরে যেতে কীভাবে? মার্থা মেয়েটিরই-বা কী রকম কাণ্ডজ্ঞান। চলে যাবার আগে তার তো দেখা উচিত ছিল বাসায় কেউ আছে কিনা।
আপনি এত রাগছেন কেন?
রাগছি না। টেলিফোন নাম্বার তো ছিল। ছিল না?
আমি কেন শুধু-শুধু টেলিফোন করব? পনের দিন ধরে এখানে আছি। আপনি কি আমাকে টেলিফোন করেছেন? এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে এসে ভাবছেন খুব উপকার করা হয়েছে, তাই না?
পাশা লক্ষ করল মেয়েটি কথা বলছে রেগে-রেগে কিন্ত মুখ হাসি-হাসি।
আমি আসতাম না। এসেছি শুধু আপনাকে টাকাটা দেবার জন্যে। ঐদিন। জিনিসপত্র কিনতে মোট কত ডলার খরচ করেছেন?
এক শ সতের।
এই নিন এক শ কুড়ি। তিন ডলার আপনার বখশিস।
রেবেকা শব্দ করে হাসল। তার বেশ মজা লাগছে। কেন লাগছে, সে নিজেও পরিষ্কার জানে না। বাংলায় কথা বলতে পারছে, এটা একটা বড় কারণ। গত সপ্তাহের উইকণ্ডের বিকেলে ডরমিটরি ছেড়ে সবাই চলে গেল। শুধু আরিয়ে রত্না ছিল। সে ঘর বন্ধ করে তাঁর নিজের দেশের ক্যাসেট চালু করে দিয়েছে। কী ভয়ানক অবস্থা।
চা খাব। চায়ের পানি গরম করুন। আজ চা বানাব আমি।
পাশা চায়ের পানি বসাল। সে বেশ অবাক হয়েছে। ঐদিন রাতে যে-মেয়েকে নিয়ে আসা হয়েছে এই মেয়ে সেই মেয়ে নয়। এ অন্য মেয়ে। যে-কোনো কারণেই হোক সে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। নতুন পরিবেশে নিজেকে কিছুটা মানিয়েও নিয়েছে।
রেবেকা বলল, আমি খুব বেশি কথা বলছি, তাই না? দেশে কিন্তু খুব কম কথা বলতাম। আপনি বোধহয় বিশ্বাস করছেন না।
করছি।
বাংলায় কথা বলতে পারছি এই আনন্দেই বকবক করতে ইচ্ছা হচ্ছে। গত পনের দিনে কারো সঙ্গে একটা বাংলা কথা বলি নি। এক বার শুধু ভুলে আরিয়ে রত্নাকে বললাম–কেমন আছেন? সে হাঁ করে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
আরিয়ে রত্না কে?
আরিয়ে রত্না হচ্ছে শ্রীলঙ্কার মেয়ে। ভালো নাম হল–আরিয়ে রত্না চন্দ্রাণী।
কোটটা খুলে আরাম করে বস রেবেকা। ছটফট করছ কেন? রেবেকা কোট খুলতে-খুলতে বলল, আজ আপনি আমাকে তুমি-তুমি করে বলছেন। আপনি কি কিছুক্ষণ তুমি, তারপর আপনি, আবার কিছুক্ষণ তুমি–এইভাবে কথা বলেন?
পাশা কী বলবে ভেবে পেল না। পানি গরম হয়ে গিয়েছিল, সে নিজেই চা বানাল।