অনেক দিন বুড়োবুড়িদের নিয়ে কোনো ছবি দেখা হয় না। একটা দেখা যেতে পারে।
আবার টেলিফোন বাজছে।
হ্যালো, পাশা চৌধুরী।
বলছি।
আমি বেল টেলিফোন থেকে বলছি–মাইকেল।
হ্যালো মাইকেল।
তুমি আমাদের কাছ থেকে কোনো নোটিশ পাও নি?
পাশা এক বার ভাবল বলে–তুমি যে-খবরটি দিতে চাচ্ছ, তা ইতোমধ্যেই দেওয়া হয়েছে, আবার দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু সে কিছু বলল না, কথা শুনে গেল।
দেড় হাজার ডলারের মতো ব্যাঙ্কে আছে। চার মাসের টেলিফোন বিল এই মুহূর্তে চেক লিখে দিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু সেটা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
গুড ডে মিঃ পাশা। কাজের মধ্যে বিরক্ত করবার জন্য দুঃখিত। দি ডার্ক ছবিটি দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা দীর্ঘস্থায়ী হল না। আজকাল কোনো পরিকল্পনাই দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
পাশা ঠিক করল, দুপুরবেলা খানিকটা ঘুমানর চেষ্টা করবে। খাঁটি বাঙালী একটি ব্যাপার। যেখানে সবাই কাজকর্ম করছে, সেখানে নরম বিছানায় আরামের ঘুম।
মেইল বক্সে বেশ কিছু চিঠি-শুয়ে-শুয়ে চিঠি পড়েও খানিকটা সময় কাটান যায়। আজ হচ্ছে ডিসেম্বরের চার তারিখ। ডিসেম্বরে প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই এপল গেমস-এর পিআরও টেলিফোন করবে। সেরকমই কথা আছে। পিআরওর কথাবার্তায় বোঝা গেছে এপল গেমস প্রাথমিকভাবে তার খেলাটি পছন্দ করেছে। চূড়ান্ত পর্যায়ের মিটিংটি হবে ডিসেম্বরের দু তারিখে। পাশা বলেছিল, আমি টাকাপয়সার একটা বড় রকমের ঝামেলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
অবস্থা বদলাবার একটা বড়ো সম্ভাবনা আছে মিঃ পাশা। গেমস ডিভিশনের অনেকের ধারণা, এই খেলাটি বড় রকমের হিট হবে। তবে আমাদের হাতে আরো কিছু ইন্টারেস্টিং গেমস-এর সফটঅয়্যার জমা পড়েছে।
সেগুলি কীরকম বলতে পারেন?
না, পারি না।
ভিডিও গেম-এর এই খেলাটি তৈরি করতে পাশার লেগেছে ছ মাস। প্রোগ্রাম লেখা, বদলান, পরীক্ষা করে দেখা। জিনিসটি দাড়িয়ে যাবে আশা ছিল না। শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে। খেলাটি এরকম:
ভিডিও ক্যাসেট কম্পুটারে লাগাবার সঙ্গে সঙ্গে একটি মানুষের ছবি ভেসে উঠবে। নিচে লেখা হবে–এই মানুষটির নাম জন। তার সঙ্গে আছে পাঁচ শ ডলার। এই পাঁচ শ ডলার নিয়ে তাকে এক মাস টিকে থাকতে হবে। সে কি পারবে?
তারপর তিনটি লটারির টিকিট ভেসে উঠবে পর্দায়। সে ইচ্ছা করলে একটি টিকিট কিনতে পারে পাঁচ ডলার দিয়ে। জিতে গেলে সে পঞ্চাশ ডলার পাবে। কোন টিকিটটি কিনবে তা নির্ভর করবে যে খেলাটি খেলছে তার ওপর। সে জানে না তিনটির ভেতর কোনটি সেই বিশেষ টিকিট।
তেমনিভাবে আসবে শেয়ার মার্কেট। সে কি শেয়ার কিনবে, না কিনবে না?
লোকটি কি এ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করবে, না করবে-না? এ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া না করে সে রেলওয়ে স্টেশনেও রাত কাটাতে পারে। কিন্তু সেখানে গুণ্ডাদের হাতে টাকাপয়সা খোয়ানর ভয় আছে।
খেলাটি যথেষ্টই উত্তেজনার। লোকটিকে জিতিয়ে দিতে হলে ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে খেলতে হবে। প্রচুর ভেরিয়েশন। খেলাটি এপল গেমস-এর পছন্দ নাহওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু সময় খারাপ, হয়তো শেষ মুহূর্তে পিআরও ঠাণ্ডা গলায় বলবে, মিঃ পাশা, আমরা অত্যন্ত দুঃখিত যে, আপনার এত চমৎকার একটি খেলা আমরা নিতে পারছি না।
শেষ পর্যন্ত এই বিশেষ খেলাটি খেলতে হবে পাশাকে। দেড় হাজার ডলারের খেলা। খেলতে হবে সাবধানে। পাশা চিঠির গাদা নিয়ে বসল। দেশের চিঠি এসেছে। তিনটি। এ সব পড়বার কোন অর্থই হয় না। চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় চিঠির বক্তব্য।
জিনিসপত্র অগ্নিমূল্য। জীবনধারণ করা কঠিন। ইত্যাদি ইত্যাদি। মূল বক্তব্য একটিই। আমাদের বেঁচে থাকার ব্যাপারে তোমার সাহায্য চাই। তোমার উপর আমার দাবি আছে। ভালবাসার দাবি, আত্মীয়তার দাবি। আমাদের দুঃসময়ে তুমি আমাদের দেখবে না?
দেশের চিঠি আগে পড়ার দীর্ঘদিনের অভ্যাস ছাড়া গেল না। অপরিচিত হাতের লেখার একটি চিঠি খুলল সে। দামী একটা কাগজে গোটা-গোটা করে লেখা। পাশার ফুফাতো বোনের স্বামী। চিঠির বক্তব্য হচ্ছে, আমেরিকা আসবার একটা ব্যবস্থা পাশা ভাইকে করতেই হবে, যেভাবেই হোক। দরকার হলে আমেরিকায় সে কুলিগিরি করবে ইত্যাদি। এই ছেলেটিকে সে চেনে না। ফুফাতো বোনের কথাও ভালো মনে নেই। নাক-বোচা একটা ছোট্ট মেয়ে দেখে এসেছিল। রাত-দিন রান্না-বাটি খেলত। একা-একা সে হাত নাড়ছে, ছাক-ছাঁক শব্দে ডাল বাগার দিচ্ছে–বিচিত্র খেলা। এই মেয়ে বড়ো হয়ে গেছে। বাবা-মার আপত্তি উপেক্ষা করে একটা বেকার ছেলেকে বিয়ে করেছে, ভাবাই যায় না। প্রথম প্রেমের স্বপ্নভঙ্গ ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। পাশা মনে-মনে ঠিক করে ফেলল, ছেলেটির চিঠির জবাব দেবে না। তবে ফুফাতো বোনকে এক শ ডলারের একটা ড্রাফট পাঠিয়ে দেবে। সঙ্গে একটি চিঠি থাকবে যাতে লিখবে–তুমি যে বিয়ে করে ফেলেছ, তা জানতাম না। তোমার ডাল রান্নার ছাঁক-ছাঁক শব্দ এখনো কানে বাজে। এক শ ডলার পাঠালাম। পছন্দসই কোন কিছু কিনে নিও। আর ভালো কথা, তোমার বর আমেরিকা আসতে চাচ্ছে। এ ব্যাপারে আমার কিছুই করণীয় নেই। এখন এ-দেশে আসবার পদ্ধতি আমার জানা নেই। তাকে দেশেই একটা কিছু করতে বল।
দ্বিতীয় চিঠিটি আমিনুল হকের, ইনি জনতা ব্যাঙ্কের কচুক্ষেত শাখার এক জন কর্মচারী। পাশার আত্মীয়। আত্মীয়তার সূত্রটি ভদ্রলোক বিশদভাবে লিখেছেন, তবুও তা পরিস্কার নয়। এই ভদ্রলোক তার ছেলেকে আমেরিকায় ইঞ্জিনীয়ারিং পড়াতে চান। তিনি শুনেছেন, এ-দেশে প্রচুর বাঙালী ছাত্র কাজকর্ম করে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। ওরা যদি পারে, তার ছেলে কেন পারবে না? তিনি কষ্টটষ্ট করে যেভাবেই হোক ছেলের ভাড়ার টাকা যোগাড় করবেন। ছেলে ভালো, ম্যাট্রিকে তিনটি লেটার নিয়ে ফাস্ট ডিভিশন পেয়েছে, তবে জ্বর নিয়ে পরীক্ষা দেবার জন্যে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা বেশি ভালো হয় নি। হায়ার সেকেণ্ড ডিভিশন আছে, ইত্যাদি।