রেবেকা, বাকি রাতটা আমরা গল্প করেই কাটালাম। শুধু গল্প অবশ্যি না, ওর সঙ্গে অন্য ব্যাপার আছে। ঐ প্রসঙ্গটি এখন তুলে আর তোমাকে রাগাতে চাই না। ঐ রাতে যা রেগেছিলে।
রেবেকা, যখন এই চিঠি লিখছি তখন তুমি পাশেই আছ। কিন্তু যখন এই চিঠি পাবে তখন পাশে থাকবে না। বিরহ দিয়ে শুরু হল জীবন। কাজেই আশা করছি, মিলনে তার শেষ হবে। অসংখ্য চুমু তোমার ঠোটে গালে এবং……। কি, আবার রাগিয়ে দিলাম?
রেবেকা চোখমুখ লাল করে ক্লাস করতে গেল। একটুও মন দিতে পারল না। লেকচারে। তবু জীবনের প্রথম কুইজ পরীক্ষায় এক শতে এক শ পেয়ে নিজে অবাক হল এবং অন্য সবাইকে অবাক করে দিল। আবদুল্লাহ্ সবচেয়ে কম নাম্বার–নয় পেয়ে খুব হাসতে লাগল, যেন বিরাট একটা বাহাদুরি করেছে।
আবহাওয়াবিজ্ঞানীর ভবিষ্যৎবাণী
ফার্গো ফোরামে এক জন আবহাওয়াবিজ্ঞানীর ভবিষ্যৎবাণী ছাপা হয়েছে। তিনি হিসেবটিসেব করে বের করেছেন, আরেকটি বরফ-যুগ আসছে। এই বরফযুগের স্থায়িত্ব হবে তিন শ বছর। সমস্ত পৃথিবী বরফে ঢেকে যাবে। সবচেয়ে উষ্ণতম স্থানের তাপমাত্রা হবে শূন্যের ত্রিশ ডিগ্রী নিচে।
খবর ছাপা হয়েছে বক্স করে। বিজ্ঞানীর ছবি আছে। হাসি-হাসি মুখের ছবি। বরফ-যুগ আগমনের সংবাদে তাকে মোটেই বিচলিত মনে হচ্ছে না।
পাশা বিরক্ত ভঙ্গিতে বিজ্ঞানীর ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইল। বিজ্ঞানীরাও আজকাল সেনসেশন তৈরি করতে চান। সবাই চায়, তারাইবা বাদ যাবে কেন?
খবরের কাগজে পড়বার মতো আর কিছু নেই। ইথিওপিয়ার কয়েকটি বীভৎস ছবি দিয়ে একটি দীর্ঘ ফিচার আছে। সেটি পড়তে ইচ্ছা করছে না। কোথায় কে না। খেয়ে আছে, তা আজকের এই ছুটির সকালে জানতে ইচ্ছা করে না।
প্রথম প্রথম এই পেট-বের-হয়ে-যাওয়া অপুষ্ট শিশুগুলোর ছবি দেখলেই গা কেমন করত। এখন করে না। পত্রিকাওয়ালারা ছবি ছাপিয়ে-ছাপিয়ে মানুষের মমতা নষ্ট করে দিয়েছে।
পাশা অন্যমনস্কভাবে কয়েকটি ছবি দেখল। প্রতিটির নিচে খুব কাব্যিক ক্যাপশন। মায়ের শুকনো দুধ দুহাতে খামচি দিয়ে ধরে আছে একটি শিশু। শিশুটিকে দেখাচ্ছে একটা বড় মাপের পোকার মত। মায়ের মুখ মিসরের মমির মতোই ভয়াবহ। নিচে লেখা-মেডোনা। কোনো মানে হয়?
ছবিটির দিকে তাকালেই মনে হয় সাংবাদিক ভদ্রলোক একটি পুরস্কার আশা করছেন। পুলিটজার পুরস্কার, লা গ্ৰান্দি পুরস্কার, দি র্যাবো অনার। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের একটি মোম ছবি মানেই অর্থ, সাফল্য এবং পরিচিতি পাশা প্রবন্ধটি পড়ে ফেলল। যা ভাবা গিয়েছিল তাই, বাংলাদেশের নাম এই প্রবন্ধে আছে। প্রবন্ধকার শেষের দিকে দুঃখ করে লিখেছেন ইথিওপিয়া, বাংলাদেশ–এই সব অঞ্চলে কোনো দিন কি আশা ও আনন্দের সূর্য সত্যি সত্যি উঠবে?
পাশার বিরক্তির সীমা রইল না। ইথিওপিয়ার কথা লিখছ ভালো কথা, আবার বাংলাদেশকে টেনে আনা কেন? মাথায় একটা সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছে। বিরক্তির কারণেই হচ্ছে। মাঝে মাঝে এই যন্ত্ৰণা দ্রুত ছড়িয়ে যায়। দুটি এক্সট্রা স্ট্রেংথ টাইলানলও ঠিক কাজ করে না। অনেক দিন ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয় না, এক বার যাওয়া দরকার। পঁয়ত্রিশের পর শরীরের ছোটখাটো অসুবিধাগুলোর দিকেও নজর রাখতে হয়।
পয়ত্রিশের পর মানুষ তার নিজের শরীরকেই সবচেয়ে বেশি ভয় করতে শুরু করে। হার্ট কি ঠিকমতো বিট করছে? ক্লান্ত হয়ে পড়ছে না তো? লিভার, সে ঠিকঠাক আছে? চোখের মণির উপর ক্যালসিয়াম দানা বাধতে শুরু করে নি তো? রোদের দিকে তাকালে রামধনু ভাসে না তো?
শোবার ঘরে টেলিফোন বাজছে। উঠে গিয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে না। আবার চুপচাপ বসে থাকতেও ভালো লাগছে না। এটাকেই কি ডিপ্রেশন বলে? পাশা উঠে দাঁড়াল। ততক্ষণে রিংবন্ধ হয়ে গেছে। সে চলে গেল শোবার ঘরে। আবার টেলিফোন আসবে। এমন লোকের সংখ্যা খুব কম, যারা প্রথম বারে না পেলে দ্বিতীয় বার রিং করে না।
আবার রিং হল। আমেরিকান মেয়ের গলা। যান্ত্রিক ভাব আছে গলার স্বরে। তার মানে সে এক জন সেক্রেটারি। প্রতিদিন তিন-চার ঘণ্টা করে তাকে টেলিফোনে কথা বলতে হয়।
পাশা চৌধুরী?
হ্যাঁ।
এই টেলিফোন কি আপনার?
মেয়েটি যন্ত্রের মতো পাশার টেলিফোন নাম্বার আওড়াল।
হ্যাঁ, আমার, কী ব্যাপার?
আমি বেল টেলিফোন থেকে বলছি। সুশান আমার নাম!
হ্যালো সুশান।
তুমি কি বেল টেলিফোন থেকে কোনো চিঠি পাও নি?
পেয়েছি।
চার মাসের টেলিফোন বিল বাকি পড়ে আছে। আমরা আর তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করব।
আমি তিন সপ্তাহের আগেই বিল দেবার ব্যবস্থা করব।
ভালো কথা, তুমি এখন থেকে এই টেলিফোনে ওভারসীজ টেলিফোন করতে পারবে না। এই অসুবিধার জন্যে আমরা দুঃখিত।
গুড ডে সুশান।
গুড ডে।
সব অফিস-সেক্রেটারির নাম সুশান হয় কেন, তাই ভাবতে-ভাবতে পাশা বসার ঘরে এল। পত্রিকায় পড়ার আর কিছু নেই। সময় কাটানর মতো ব্যবস্থা করা যায় কি? ছবি দেখলে কেমন হয়? অনেক দিন ছবি দেখা হয় না।
ফার্গো ফোরামে দুটি কলাম জুড়ে আছে ছবির খবর। কোন নামই পরিচিত মনে হচ্ছে না। একটি নাম খানিকটা পছন্দ হচ্ছে–দি ডার্ক। ভূতের কাণ্ডকারখানা হবে। ছবি সম্পর্কে কোনোতথ্য নেই। শুধু লেখা পিজি। প্যারেন্টাল গাইডেন্স। বাবামারা যদি মনে করেন, তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই ছবি দেখতে পারেন।
দুপুরবেলা ভূতের ছবি দেখে খানিকটা ভয় পাওয়া মন্দ কি? বিরক্তির ভাবটা তো কাটবে। ভয় পাওয়ার জন্যে কিছু বুড়োবুড়ি নিশ্চয়ই থাকবে হলে। সামান্য শব্দেই চেচিয়ে উঠে একটা কাণ্ড করবে।