এই বয়সে পরীক্ষা দেব কী? তাছাড়া কেমিষ্ট্রি আমার কিছুই মনে নেই।
ড. ওয়ারডিংটন বললেন, কারো কিছু বলার আছে? কোনো প্রশ্ন? কোন সাজেশান?
এক জন আমেরিকান বলল, আমাদের কি সাইড সিইং-এ কোনো প্রোগ্রাম আছে?
না, নেই। এই অঞ্চলে দেখার কিছু নেই। তবে তোমরা যদি কনট্রিবিউট করতে চাও, তাহলে সাউথ ডাকোটায় একটা টিপের ব্যবস্থা করা যাবে। যারা উৎসাহী তারা হাত তোল।
আমেরিকানরা সবাই হাত তুলল। আর তুলল আবদুল্লাহ্। সে দুহাত তুলে বসে আছে।
কফি-ব্রেক দেওয়া গেল। রুম নাম্বার ইলেভেন–পেট্রিসিয়া হলে কফি দেওয়া হয়েছে। গুড ডে।
রেবেকা উঠতে যাচ্ছিল। ওয়ারডিংটন তার কাছে এগিয়ে এসে বললেন, তুমি আমেরিকা পৌঁছানর আগেই তোমার নামে দেশ থেকে চিঠি এসেছে। এই নাও। আশা করি এটা তোমার জন্যে একটা প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ। এই নাও।
রেবেকা হতভম্ভ হয়ে চিঠি নিল।
ওয়ারডিংটন বললেন, প্রেমিকের চিঠি নিশ্চয়ই। শুধুমাত্র প্রেমিকরাই এত ভারি চিঠি লেখার সময় পায়।
রেবেকা লজ্জায় লাল হয়ে বলল, আমার স্বামীর চিঠি, স্যার।
তাহলে নিশ্চয়ই নিউলি ম্যারেড?
জি-স্যার।
তোমার স্বামী এক জন বুদ্ধিমান লোক। তুমি দেশ থেকে রওনা হবার আগেই সে নিশ্চয়ই চিঠি লিখেছে, তাই না?
রেবেকা কিছু বলল না।
চল, কফি খেতে যাই। কফি খেতেখেতে তুমি তোমার স্বামীর চিঠির উত্তেজক অংশগুলি আমাকে পড়ে শোনাবে। হা-হা-হা।
বাবার বয়েসী এক জন ভদ্রলোকের বার্তার কি অদ্ভুত ধরন! যেন সে তার বান্ধবীর সঙ্গে গল্প করছে।
ওয়ারডিংটন হঠাৎ কৌতূহলী স্বরে বললেন, তোমার হাতের তালুতে লাল রঙের নকশা দেখতে পাচ্ছি। ব্যাপারটা কী?
বিয়ের সময় আমাদের দেশের মেয়েরা হাতে এরকম নকশা করে।
এই নকশা কি সারা জীবন থাকে? পার্মানেন্ট?
না, কিছু দিন থাকে। তবে বলা হয়, সুখী স্বামী-স্ত্রীদের বেলায় এই রঙ দীর্ঘদিন থাকে।
ভেরি ইন্টারেস্টিং। আগামী সপ্তাহে আমার স্ত্রী আসবে মিনেসোটা থেকে। তাকে তোমার হাত দুটি দেখাতে চাই। তত দিন পর্যন্ত নকশাগুলি থাকবে আশা করি। থাকবে না?
জ্বি-স্যার, থাকবে।
তার মানে কি এই, তোমরা খুব সুখী স্বামী-স্ত্রী?
রেবেকা লজ্জা পেয়ে গেল। সে ভেবেছিল বুড়ো ওয়ারডিংটন সত্যি সত্যি তার পাশে বসবেন এবং চিঠি পড়তে চাইবেন। সেরকম কিছু হল না। তিনি একটি সোনালি চুলের আমেরিকান মেয়ের সঙ্গে রসিকতা করতে লাগলেন।
মেয়েটি হাসছে। তিনিও হাসছেন। সোনালি চুল কী বলে যেন খোঁচা দিল ওয়ারডিংটনের পেটে। দুজনেই হাসছে। এই আনন্দের সবটুকুই কি সত্যি? ভান নেই এর মধ্যে?
রেবেকা ভেবেছিল, কফি খেতেখেতে সে চিঠি খুলবে না। নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে পড়বে। তারপর ঠিক করল শুধু খামটা খুলবে, চিঠি পড়বে না। সে-প্ৰতিজ্ঞাও রইল না। সে ঠিক করল, প্রথম চারটি লাইন পড়বে। গুনে গুনে চার লাইন। এর বেশি নয়।
কিন্তু সে গোটা চিঠিই পড়ে ফেলল–রেবা খুব অবাক হয়েছ, তাই না? অবাক করবার জন্য কষ্ট করতে হয়েছে। তোমাকে জানতে না দিয়ে আমেরিকার ঠিকানা যোগাড় করাটাই ছিল সবচে বড়ো কষ্ট। তারপর চিঠি লেখা। প্রথম চিঠি। কোনো বানান ভুল যেন না হয়। বাসায় নেই ডিকশনারি। এক শ ত্রিশ টাকা খরচ করে কিনলাম ডিকশনারি। এটা কিনেও এক বিপদ। যে-বানানই লিখি, মনে হয় ভুল। ডিকশনারি খুঁজতে গিয়ে সেই শব্দ পাই না। তারপর আছে ভাষার ব্যাপার। আমি চিঠি খুব বেশি লিখি না। কায়দা-কানুন ভালো জানা নেই। তুমি নিশ্চয়ই খুব হাসবে। তবে হাস আর যাই কর, এই চিঠি তোমাকে প্রচুর আনন্দ দেবে। এই নিয়ে আমি বাজি রাখতে পারি। প্রবাসী জীবনে চিঠির মূল্য অনেক বেশি। সেই চিঠি যদি প্রিয়জনের লেখা হয়, তাহলে তো কথাই নেই।
মাত্র এক দিনের পরিচয়ে নিজেকে তোমার প্রিয়জন ভাবছি। তুমি আবার হাসছ না তো? কীরকম হুট করে বিয়ে হয়ে গেল আমাদের, তাই না? তোমার দুলাভাই ঠিক করলেন–তোমাদের বাসাতেই বাসর হবে। তাড়াহুড়া করে একটা ঘরে বিছানা করা হল। ফুল না পাওয়ার জন্যই হয়তো তোমার ছোট বোন পুরো এক সেন্টের শিশি উপুড় করে দিল বিছানায়। কড়া গন্ধে মাথা ধরে যাবার উপক্রম। আমি বসে আছি তোমার জন্য। তোমার আসার নাম নেই। সম্ভবত আসতে রাজি ছিলে না। অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে রাজি করাতে হয়েছে। কাদতে-কাদতে চোখমুখ ফুলিয়ে তুমি এলে। এসেই উল্টোদিকে মুখ করে শুয়ে পড়লে। বন্ধুবান্ধবের কাছে বাসর রাতের কত গল্প শুনেছি। বাসর রাতে স্বামী-স্ত্রী আবেগে অভিভূত হয়ে কত ছেলেমানুষি কাও করে। আমাদের বেলায় সে-সব কিছুই হচ্ছে না। আমার একসময় ধারণা হল তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ। আমি পরীক্ষা করবার জন্যে বললাম, রেবেকা, তোমার কাছে সেফটিপিন আছে? মশারিটা এক জায়গায় ছেড়া, মশা ঢুকছে। তুমি দারুণ লজ্জা পেয়ে উঠে বসলে। ছেড়া মশারির জন্যে অপমানিত বোধ করলে বোধহয়। সেফটিপিন দিয়ে ছেড়া মেরামত করা হল। তখন আমি আরেকটি ছেড়া বের করলাম। তুমি চোখ-মুখ লাল করে সেটিও বন্ধ করলে। এবং বললে, আপনি এরকম করে আসছেন কেন?
হাসলে কেউ রাগ করে?
ছোঁড়া মশারির কারণে তোমার সঙ্গে কিছুটা কথাবার্তা হল। তারপর আমি বললাম, রেবেকা, আমাকে একটু বাথরুমে যেতে হয়। তোমাদের বাথরুমটা কোন দিকে?
তুমি পাংশুবর্ণ হয়ে গেলে। কারণ পরিষ্কার হল কিছুক্ষণের মধ্যেই। বিদেশযাত্রা উপলক্ষে তোমাদের আত্মীয়স্বজন জড়ো হয়েছে। মেঝেতে ঢালাও বিছানা। যে যেখানে পেরেছে ঘুমিয়ে আছে। বাথরুমে যেতে হলে ওদের ডিঙিয়ে যেতে হবে। তুমি ক্ষীণ স্বরে বললে, এদের উপর দিয়ে চলে আসুন। কিছু হবে না।