ভাত।
ভাত ছাড়া আর কী?
আর কিছু না।
ফকিরের মাইয়া বলে কী? শুধু ভাত খাব কীভাবে?
আর কিছু রানতে জানি না।
এর ওপরে কোনো কথা চলে না। রাঁধতে না জানলে সে করবে কী? কামাল বলল, শুকনো মরিচ ভেঙ্গে ফেল। পেঁয়াজ আর শুকনো মরিচের ভর্তা বানিয়ে খাওয়া যাবে। মরিচের ভর্তা ঠিকমতো বানাতে পারলে কোপ্তা-কালিয়ার মতো টেস্ট হয়। ঘরে সরিষার তেল আছে তো? সরিষার তেল দিয়ে হেভি ডলা দিতে হবে।
বিড়ালটা পায়ের কাছে ঘুর ঘুর করছে। আহ্লাদ করছে। কামাল নিচু হয়ে বিড়ালটাকে খানিকক্ষণ আদর করল। আদর খেয়ে সে একেবারে চলে যাচ্ছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি। আদর সবাই বোঝে। শুধু মানুষ ববাঝে না। মানুষ হচ্ছে বিচিত্র চিড়িয়া। সে আদর সোহাগ বোঝ না। রাগটা বোঝে। ঘৃণা বোঝে। শালার মানুষ।
মিনু।
জ্বি।
বেড়ালটারে দুধ দিয়েছিলি?
না। না কি রে হারামজাদী—এমন চড় দেব……
দুধ কেমনে বানাইতে হয় জানি না।
কামাল রাগ সামলে নিল। যে দুধ বানাতেই জানে না তাকে দুধ না বানানোর জন্যে চড় দেওয়া যায় না। সোমা এই মেয়েটাকে দেখি কিছুই শেখায় নি। অকৰ্মার ধাড়ি করে রেখেছে।
ও মিনু।
জ্বি।
খাওয়াদাওয়ার পর দুধ বানানো শিখিয়ে দিব-বুঝলি। খুব সোজা। বিড়ালটাকে রোজ দুধ দিবি। পেটে বাচ্চা আছে। এই সময় ভালোমল খাওয়ার দরকার। আর খবরদার লাথিফাথি দিবি না। বাচ্চার ক্ষতি হবে। যা ভাত বাড়। শুকনো মরিচ ভাজ। পুড়িয়ে আবার কালো করে ফেলিস না। কালো যদি হয় এক থাবড়া খাবি।
সাবান গামছা নিয়ে কামাল বাথরুমে ঢুকে পড়ল। বাথরুমে ঢুকেই তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কি সুন্দর সাজানো বাথরুম। ঝক ঝক করছে। এককণা ময়লা কোথাও নেই। অপরিষ্কার বাথরুম ছিল সোমার দু চোখের বিষ। সোমার মতে বাথরুম এমন হবে যেন ঢুকলেই মনের মধ্যে একটা পবিত্র ভাব হয়। এই মেয়ের কথাবার্তার কোন মা-বাপ নেই। পরিষ্কার বাতিক। এত পরিষ্কার দিয়ে হয় কি? দুনিয়াটাই অপরিষ্কার। এর মধ্যে পরিষ্কার পরিষ্কার করে চেঁচালে কি হবে? কিছুই হবে না। আজ এই বাথরুম ঝক ঝক করছে। সাত দিন পরে করবে না। তাতে কোনো অসুবিধা হবে না। কোনকিছুই আটকে থাকে না। কামাল গায়ে পানি ঢালতে লাগল। ঠাণ্ডা পানি গায়ে ঢালতে বড় আরাম লাগছে। ঘুম এসে যাচ্ছে। সে গুন গুন করে একটা সুর ভাঁজল। তার বেশ ভালো লাগছে।
কামাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমুল। ঘুম ভাঙার পর ডাকল, সোমা, ও সোমা। এক দিনে দ্বিতীয় বার ভুল। মেজাজ খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা। মেজাজ কিছুটা খারাপই হল। যে গেছে সে গেছে—এখন ডাকাডাকি করে হবেটা কী? কিছুই হবে না। মানিয়ে নিতে হয়। সব অবস্থায় সব পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়াটাই হচ্ছে বড় কথা।
মিনু।
জ্বি।
চা বানা দেখি।
চা রানতে জানি না।
অতি উত্তম। হারামজাদী, তুই জানিস কি? ফ্লাস্ক নিয়ে যা মোড়ের দোকান। থেকে চা নিয়ে আয়। বিড়ালকে দুধ দিয়েছিলি?
হ।
গুড। দু বেলা দুধ দিবি সকালে এক বার, রাতে এক বার। যা চা নিয়ে আয়।
কামাল বিছানা ছেড়ে নামল। হাতমুখ ধুয়ে সিগারেট ধরাল। তার মনে হল সোমার অভাব সে যতটা বোধ করবে ভেবেছিল তার চেয়ে অল্প একটু বেশি বোধ করছে। এর কারণ সে ঠিক ধরতে পারছে না। তার হিসাবে ভুল খুব একটা হয় না। এখানে ভুল হল কেন?
মিন ফ্লাস্কে করে চা নিয়ে এসেছে। হোটেলের চা বিম্বাদ হলেও এর আলাদা একটা স্বাদ আছে। এই স্বাদে আবার অভ্যস্ত হয়ে যেতে হবে। সেটা মন্দ কি। স্বাধীন জীবনের আলাদা আনন্দ আছে। চা খেতে খেতে কামালের মনে হল—শুধু স্বাধীন জীবন না, সবধরনের জীবনেরই আলাদা আনন্দ আছে। যে তের মাস সে জেল খাটল সেই তের মাস সময়টাও তার খুব একটা খারাপ কাটে নি। জেলে তার সঙ্গীরা মানুষ হিসেবে খারাপ ছিল না। যথেষ্ট বুদ্ধিমান। শুধু বুদ্ধিমান নারসিকও ছিল। এদের এক জন বিনয় পোদ্দার। বার বছরের কয়েদ হয়েছিল। কি অসম্ভব রসিক মানুষ। তার আশেপাশে থাকাই একটা আনন্দের ব্যাপার। এক বার জেলখানায় ইম্প্রভ ডায়েট হল ঈদ উপলক্ষে। পোলাও, গোস্ত আর একটা করে চপ। চপ মুখে দিয়েই সবাই থুথু করে ফেলে দিল। বাসি চপ। গরমে টক হয়ে গেছে। বিনয় পোদ্দার বলল, বাসি চপের গল্প শুনবে নাকি হে তোমরা। সবাই হৈ হৈ করে উঠল, বলেন, বলেন।
এক বার এক হোটেলে গেছি। চপের অর্ডার দিয়েছি। চপ আসল। মুখে দিয়ে দেখি, সর্বনাশবাসি মানে, পচে যাওয়া মাল। মেজাজ গেল গরম হয়ে। বেয়ারাকে বললাম, ডাক তোমার ম্যানেজারকে। এই পচা চপ খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। বেয়ারা মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, আপনি নিজেই যে জিনিস খেতে রাজি না ম্যানেজারবাবু সেটা কি করে খাবেন বলুন।
আহ কি গল্প। আর কি গল্প বলার ভঙ্গি। কামাল বিমর্ষ বোধ করছে। সন্ধ্যা সময়টা আসলেই খারাপ। মন ভার ভার হয়ে থাকে। সন্ধ্যায় এই জন্যে ঘরে থাকতে নেই।
মিনু!
জ্বি।
আমি এখন বেরুব বুঝলি। ফিরতে রাত হবে। একা একা ভয় লাগবে?
হুঁ।
তা হলে কী করা যায় বলত?
আফা আসবে না?
না। ঐ সম্পর্ক শেষ। এখন তুই কী করবি চিন্তা করে দেখ। তোর খালার কাছে যাবি? তোর খালা থাকে না কলতাবাজার। যাবি সেখানে?
না।
যাবি না কেন?
খালা খাওন দেয় না।
এ তো দেখি আরেক যন্ত্রণা। তোকে কোলে নিয়ে আমি ঘুরব না-কি?
মিনু হেসে ফেলল। সঙ্গে-সঙ্গে হাসি লুকাবার জন্যে মুখ ঘুরিয়ে নিল। এই লোকের সামনে হাসতে বড় ভয় লাগে।