মানুষ সবকিছুকেই অবিশ্বাস করে। চোখের পানিকে করে না। ভাগ্যিস করে না। যদি করত তা হলে কামালের মতো মানুষদের খুব অসুবিধা হত।
দলিল তৈরি কামালের মূল ব্যবসা নয়। তার মূল ব্যবসা জমি বেচা-কেনা। একদল লোক বিদেশে চাকরি করতে যাওয়ায় এই ব্যবসা খুব রমরমা হয়েছে। কিছু মানুষের হাতে কাঁচা টাকা-পয়সা এসেছে যাদের হাতে কোনো কালেই কোনো পয়সাকড়ি ছিল না। হঠাৎ পাওয়া ধন তারা কি করবে বুঝতে পারে না তখন জমির টোপ ফেলতে হয়। এগুতে হয় খুব সাবধানে। এইসব ধনীরা সাধারণত খুব সন্দেহপরায়ণ হয়। কোনকিছুই তারা বিশ্বাস করে না। সবকিছুতেই অবিশ্বাস। পাকা দলিল দেখেও বলে—দলিলটা তো নকল। তাদের ঘায়েল করতে হয় তাদের নিজেদের অস্ত্রে। যেমন গত মাসে কামাল একটা কেইস করল পার্টির বাসা নূরজাহান রোডে। ছোট ভাই কাজ করছে বিদেশে। টাকাপয়সা ভালোই পাঠাচ্ছে। খোঁজ-খবর আগে থেকে ভালোমলতা নিয়ে কামাল উপস্থিত হলহাতে ব্রিফকেস। চোখে চশমা।
বড় ভাই দরজা খুলে খুবই সন্দেহজনকভাবে তাকাতে লাগল। কামাল বলল, ভাই, আমার নাম কামাল। শুনলাম জমি কিনতে চান, সেই জন্যে আসলাম।
বড় ভাই মুখ লম্বা করে দিয়ে বলল, কার কাছে শুনলেন?
সেটা দিয়ে তো ভাই আপনার দরকার নাই। কিনবেন কি কিনবেন না সেটা দিয়ে। হচ্ছে কথা। যদি বলেন না, তা হলে বিরক্ত করব না। চলে যাব। যদি বলেন হ্যাঁ, তা হলে বসব। কথা হবে।
সন্দেহপ্রবণ লোকেরা সোজাসুজি কথায় সাধারণত একটু ঘাবড়ে যায়। কারণ এরা সারা জীবনেও সোজাসুজি কথা বলে না।
বড় ভাই বললেন, জমি কোথায়?
সারা ঢাকা শহর জুড়ে আমার জমি নাই। এক জায়গাতেই আছে। তিন বিঘা জমি আছে। জায়গাটা হচ্ছে সাভার। জায়গার নাম নয়নপুর।
এত দূর জমি কিনব না।
ঠিক আছে। না কিনলে কি আর করা, নেন ভাই একটা সিগারেট নেন। কামাল সস্তা ধরনের একটা সিগারেট বের করল। সন্দেহপ্রবণ লোকদের দামি সিগারেট দেওয়া যায় না। দামি সিগারেট দিলেই ভাবে কোন একটা মতলবে এসেছে।
বড় ভাই সিগারেট নেন। নেবেন জানা কথা। বিনা পয়সার কোনো জিনিস এরা ছাড়ে না। কামাল নিজের মনেই বলে সবাই জমি কিনতে চায় ঢাকা শহরে। দূরে কেউ যাবে না। ঢাকা শহরে কি জমি আছে যে কিনবে? বিনা ঝামেলায় একটা প্লট কেউ বার করুক ঢাকা শহরে। যদি বার করতে পারে আমি কান কেটে ফেলে দিব। জমি কিনার পর মিউটেশান করতে গেলে দেখা যায় আরেক পার্টির কাছে জমি বিক্রি করা। এর পর বের হয় থার্ড পার্টি। এই থার্ড পার্টি জমি দখল করে বসে থাকে। মামলা ঠুকে দেয়। রাইট অব পজেশান। এইসব দেওয়ানি মামলার অবস্থা জানেন? দেওয়ানি মামলা হল আপনার কচ্ছপের কামড়। এক বার ধরলে আর ছাড়ে না। পনের বছর, বিশ বছর, পঁচিশ বছর মামলা চলতে থাকে।
আচ্ছা ভাই যাই। অনেক বিরক্ত করলাম।
বসেন একটু। রোদের মধ্যে এসেছেন। এক কাপ চা খান।
কামাল সঙ্গে-সঙ্গে বলে, তা খাওয়া যায়। চা পেলে বড় ভালো হয়। চা আসে। কামাল বলে, একটা ভালো সিগারেট খাবেন ভাই সাব? নিজের জন্যে কিছু ভালো সিগারেট আলাদা রাখি। কোনো শালাকে দেই না। নিন একটা খান।
বড় ভাই সিগারেট ধরান। এর মধ্যে লোটার প্রতি তাঁর সন্দেহ খানিকটা কমে এসেছে। তিনি মনে করতে শুরু করেছেন—লোকটা ভালো, এককথার মানুষ। কামাল বলে, একসময় ধানমণ্ডির জমি কেউ কিনতে চাইত না। চোখ আসমানে তুলে বলত, সর্বনাশ! এত দুরে জমি কিনে কি করব? জংলা জায়গা! আর আজ সেই জংলা জায়গার অবস্থা দেখেন।
ঠিক বলেছেন।
সাভারেও লোকজন এখন জমি কিনতে চায় না। বলে জংলা জমি। আমি হাসি। আর মনে-মনে বলি-ব্যাটা দশটা বছর যাক তার পর তোর মুখখান এক বার এসে দেখে যাব।
বড় ভাই বলেন, সাভারের জমি কি আপনার?
পাগল হয়েছেন? আমি জমি পাব কোথায়? আমি একজন পথের ফকির। জমি আমার বড় মামার। আমাকে বলেছে বিক্রি করে দিতে। আমার হয়েছে মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা। ঐ জমি বিক্রি হবে না। বেহুদা পরিশ্রম।
বিক্রি হবে না কেন?
তিন বিঘা জমি পুরোটা এক জনের কাছে বেচতে চায়। কার দরকার পড়েছে। একসঙ্গে এতটা জমি কেনার? ভাই উঠি দেরি হয়ে গেছে। চা-টা ভালো বানিয়েছেন।
আরে বসেন না। আরেক কাপ চা খান। অসুবিধা কি? খান আরেক কাপ চা।
কামাল বসে। আরাম করেই বসে। পার্টি টোপ গিলে ফেলেছে। এখন শুধু সুতা ছাড়তে হবে। সুতা ছাড়তে তার বড় ভালো লাগে। সুতা ছেড়ে মাছ সবসময় ঘরে তোলা যায় না। সুতা ছিঁড়ে যায়। তবে এই মাছ সে তুলেছিল। অবিশ্বাসী লোক যখন কাউকে বিশ্বাস করে তখন পুরোপুরিই করে। এই লোক করেছিল। ইচ্ছা করলে লোকটাকে সে পথের ফকির করতে পারত। তা সে করে নি। মায়া লাগল। বায়নার পঁচিশ হাজার টাকা নিয়েই ছেড়ে দিল। মনে মনে বলল, ব্যাটা ফকিরের পোলা, তোক মাফ করে দিলাম।
বাসায় ফিরতে ফিরতে তিনটা বেজে গেল। দরজা খুলল মিলু। কামাল সার্ট খুলতে-খুলতে অভ্যাসমতো ডাকল, সোমা, ও সোমা। ঢাকার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়ল সোমা নেই। মিনু দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছে। তাঁর চোখে কৌতূহলের সঙ্গে খানিকটা ভয়ও মিশে আছে। মানুষটিকে সে বেশ ভয় করে। লোকটাকে তার পাগলা পাগলা মনে হয়। জ্বর কমেছে না-কি রে মিনু?
হ।
রান্নাবান্না করেছিস কিছু?
হ।
আরে যন্ত্রণা, সবকথা এক অক্ষরে বলছিস কেন? চড় খাবিবুঝলি। ঠাশ করে একটা চড় দিব। কী বেঁধেছিস?