আরে বুসন না। আরেকটু বসুন। লাচ্ছি খান। লাচ্ছি আনতে গেছে।
লাচ্ছি খেলে তো আমার হবে না—আমার তো আরো কাজকর্ম আছে।
এখানেও কাজকর্মই তো করছেন—তাই না।
করছি আর কোথায়। কথাবার্তা বলছি। এত কথা আমার ভালো লাগে না। দরে বনলে কাজ করবেন, না বলে না।
সুলতান সাহেব বললেন, সামান্য কাজ এত টাকা চাচ্ছেন।
কামাল শান্ত গলায় বলল, কাজটা সামান্য না। এটা আমিও জানি, আপনিও জানেন। দলিল তৈরি করে দিব। সেই দলিল হবে আসল দলিলের বাবা। কোর্টে গেলে আমার দলিল টিকবে। আসলটা টিকবে না। এই জন্যে টাকা খরচ করবেন না? পঞ্চাশ লাখ টাকার সম্পত্তি পাবেন আর এক লাখ টাকা খরচ করবেন না?
সুলতান সাহেব বললেন, আপনাকে ত্রিশ দিতে পারি তবে জিনিস দেখার পরে, তার আগে না। দেখেন আপনি রাজি আছেন কি-না।
কামাল গম্ভীর হয়ে রইল। লাচ্ছি চলে এসেছে। সে বিনা বাক্য ব্যয়ে একটানে লাচ্ছি শেষ করে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে বলল, উঠি তা হলে ভাইসাব-স্লামালিকুম।
উঠি মানে? হ্যাঁ-না কিছু বলেন।
আমি ভাইসাব এককথার মানুষ। এক লাখ চেয়েছি এক লাখ দেবেন। পুরানো স্ট্যাম্প জোগাড় করে নিব, কলম দিয়ে লেখলেই দলিল হয় না। রেকর্ড রুমের রেকর্ড ঠিক করা লাগে। খাজনার রসিদ লাগে। মিউটেশনের কাগজপত্র লাগে। আমার কাজকর্ম আপনে জানেন না, তাই মাছের দর শুরু করেছেন। নকল দলিল এক হাজার টাকা দিলে করা যায়, কিন্তু ঐ জিনিস কোর্টে গেলে জজ সাহেব ঐ দলিলে নাকের সর্দি ঝাড়বে, বুঝলেন?
কামাল উঠে পড়ল। এটা হচ্ছে তাদড় পার্টি। এখানে লাভ হবে না। খালি খেলাবে। গোসল করতে চায় অথচ চুল ভিজাতে চায় না। হারামজাদা।
সুলতান নড়েচড়ে বসলেন। মুধর স্বরে ডাকলেন, কামাল সাহেব।
কি-বলেন।
সামনের সপ্তাহে কি আরেক বার আসতে পারেন?
কেন?
না মানে, আরো ঠাণ্ডা মাথায় একটু ভেবে দেখতাম।
গরম যা পড়েছে তার মধ্যে তো মাথা আর ঠাণ্ডা যাবে না। যত চিন্তা করবেন মাথা তত গরম হবে।
সুলতান সাহেব বললেন, প্লিজ আপনি সামনের সপ্তাহে এক বার আসুন। আমার বড় শ্যালকও থাকবে। সে হচ্ছে এক জন ল ইয়ার। আইনের ব্যাপারগুলো ভালো বুঝবে। আপনি আসুন। আমি আসা-যাওয়ার খরচ দিয়ে দিচ্ছি।
সুলতান সাহেব মানিব্যাগ খুলে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করলেন। কামাল মনে মনে বলল, শুয়োরের বাচ্চা, আসা-যাওয়ার খরচ পঞ্চাশ টাকা? মুখে বলল, এই পঞ্চাশ টাকা আপনি রেখেই দেন ভাইসাব। পঞ্চাশ-এক শ আমি নেই না। ডেইলি পঞ্চাশ টাকা আমি ভিক্ষাই দিই। পাপ কাজ করি তো, দান-খয়রাত করতে হয়। উঠলাম ভাই, স্লামালিকুম।
দাঁড়ান, দাঁড়ান—একটু দাঁড়ান। এত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কেন?
সুলতান সাহেব ভেতরে চলে গেলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে পাঁচ শ টাকার একটা নোট নিয়ে এসে অমায়িক গলায় বললেন, এই নিন আপনার খরচ। সামনের সপ্তাহে আসুন, দেখি একটা এগ্রিমেন্টে যাওয়া যায় কি-না। এইসব কথা কি লাখ কথার কমে হয়?
হবার হলে এক কথাতেই হয় না হলে লাখ কথাতেও হয় না। আমি আসব সামনের সপ্তাহে। সন্ধ্যা নাগাদ আসব। বুধবার সন্ধ্যা।
আচ্ছা।
কামাল ঘর থেকে মোটামুটি খুশি হয়েই বের হল। তাদড় পার্টির কাছ থেকে পাঁচ শ টাকা বের করা গেছে এই যথেষ্ট। এই পার্টির ত্রিসীমানায় সে আর আসবে না। আসার দরকার নেই। এই পার্টির কাছ থেকে আর কিছু পাওয়া যাবে না। ঢাকার বাসে উঠে সে পাঁচ শ টাকার নোটটা চোখের সামনে মেলল। ছেড়া নোট। স্কচ টেপ দিয়ে মেরামত করা। মনে মনে বলল, হারামজাদা। দুনিয়া সুদ্ধ লোক ঠকাতে চাস। ব্যাটা ফকিরের পোলা।
ফকিরের পোলা হচ্ছে কামালের একটা প্রিয় গালি। তবে এই গালি সে সবসময় মনে মনে দেয়। মনে মনে গালি দিতে পারার সুযোগ থাকায় সে আনন্দ বোধ করে। তার ধারণা মনে মনে গালাগালি দেবার সুযোগ না থাকলে বিরাট সমস্যা হত। গাল দিলেই রাগ বাষ্প হয়ে যায়। কামাল আবার বলল, হারামজাদা ফকিরের পোলা।
কামালের কাজকর্ম খুব পরিষ্কার। সে কখনো বেশি ঝামেলায় যায় না। নকল দলিলের কথাবার্তা পাকা করে। বেশ কিছু দলিলেন নমুনা দেখায় তারপর সটকে পড়ে। দিন পনের পর যখন পার্টি মোটামুটি নিশ্চিত যে, সে সটকে পড়েছে তখন হঠাৎ উদয়। হয়। মুখ-চোখ কালো করে বলে, বিরাট সমস্যা ভাই সাব। পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তিন দিন ছিলাম হাজতে। জামিনে ছাড়া পেয়েছি। পার্টি এইকথা ঠিক বিশ্বাস করে না। সে বাঁ হাতের কনুইয়ের ওপর একটা কালো দাগ দেখিয়ে বলে, এই দেখেন ভাই অবস্থা। মারের নমুনা দেখেন।
হাতের এই দাগটা কামালের জন্মদাগ। তবে মারের কারণে কালো হয়ে যাওয়া দাগ হিসেবে একে অনায়াসে চালিয়ে দেওয়া যায়। কামাল গম্ভীর গলায় বলে, কার কি কাজ করছি এটা জানার জন্যে পুলিশ হেভি চাপ দিল। আপনাদের কথা অবশ্য কিছু বলি নাই।
পার্টি এই কথায় একটু সচকিত হয়। নড়েচড়ে বস। তখন কামাল বলে, আপনাদের জানাশোনার মধ্যে পুলিশের বড় কেউ আছে? বিরাট বিপদে পড়েছি ভাইসাব।
এই পর্যায়ে কামালের চোখে পানি এসে যায়, চোখে পানি আনার ক্ষমতা কামালের অসাধারণ। অতি অল্পসময়ে সে তা পারে। তার জন্যে যা করতে হয় তা হচ্ছে চোখের পলক না ফেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। এতেই কাজ হয়। চোখে পানি আসে। তার চোখে একটা সমস্যা আছে। ছোটবেলায় চোট পেয়েছিল। এর জন্যে হয়তো চোখে পানি আসে খুব তাড়াতাড়ি।