চার হাজার? আমাকে তো বললেন, আট হাজার।
একেক জনের কাছে একেক কথা বলছেন। কোনটা সত্যি কে জানে। গাছ কাটার লোকও চলে এসেছে। বিজু ভাইয়া বলেছে গাছে হাত দিলে খুনখুনি হয়ে যাবে।
বিশ্রী ব্যাপার দেখি।
কি যে বিশ্রী–কল্পনা করতে পারবে না। রোজ ঝগড়া। জঘন্য সব গালাগালি। বড় চাচা ঐ দিন বলে গেল গুণ্ডা দিয়ে বিজু ভাইয়ার চোখ উপড়ে নেবে।
সে কি?
চল আপা, রান্নাঘরে চল। রান্নাঘরে গেলেও তোমার খারাপ লাগবে। মা যা মারা মেরেছেন। খবরদার, আবার ঐ নিয়ে কথা বলতে যেও না। কিছু বললেই মা…….
ঊর্মি কথা শেষ করল না। কারণ জাহানারা এক কাপ চা হাতে ঘরে ঢুকেছেন। সোমা নিচু হয়ে সালাম করল। জাহানারা বললেন, সালাম কেন আবার? নে চা নে। নাশতা খেয়ে এসেছিস?
না।
বিজুরা আসুক। একসঙ্গে নাশতা দেব। তোর জিনিসপত্র কোথায়?
ঐ স্যুটকেস। জিনিসপত্র আর কিছু নেই।
আনতে দেয় নি?
নিজেই আনি নি।
ব্যবহারী জিনিসগুলো তো আনতে পারতি। আবার তো টাকা খরচ করে কিনতে হবে। হাতের বালাগুলো কোথায়?
রেখে এসেছি।
রেখে এলি কেন?
আমার আনতে ইচ্ছা করল না।
জিপের শব্দ শোনা গেল। ঊর্মি চলে গেল দরজা খুলে দেবার জন্যে। জাহানারা মেয়েকে হাত বাড়িয়ে নিজের দিকে আকর্ষণ করলেন। এই মেয়েটি তাঁর বড় আদরের। জাহানারার চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে।
সোমা মৃদু স্বরে বলল, চা গায়ে পড়ে গেছে মা। হাত আলগা কর। জাহানারা হাত আলগা করলেন না। সোমা ভেবে রেখেছিল, এ-বাড়িতে এসে সে কিছুতেই কাঁদবে না। কঠিন পাথর হয়ে থাকবে। এই প্ৰতিজ্ঞা সে রাখতে পারল না। মাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো কাঁদতে লাগল। বিজু ভেতরে একনজর উকি দিয়ে আবার বাইরে চলে গেল।
সাইফুদ্দিন সাহেব ভেতরে ঢুকলেন। কি বলবেন, এটা ঠিকঠাক করতে করতে তাঁর অনেক সময় গেল। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর কিছু মনে আসে না। বিশেষ বিশেষ ঘটনায় তিনি কি বলবেন তা আগে থেকেই ঠিকঠাক করা থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘটনা বদলে যায়। ঠিক করে রাখা কথাগুলো বলা হয়ে ওঠে না। আজকের দিনের জন্যে যেসব কথা ঠিক করে রেখেছেন সেগুলো হচ্ছে, সবকিছু যে ভালোয়-ভালোয় শেষ হয়েছে এটা অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপার। আরো খারাপ হতে পারত। সেটা হয় নি। এখন পুরানো কথা সব ভুলে গিয়ে একটা ফ্রেশ স্টার্ট নিতে হবে। লাইফের রিয়েলিটি স্বীকার করতে পারা হচ্ছে বিরাট গুণ।
ঠিক করে রাখা কথা একটাও বলা গেল না। হাউমাউ করে যে-মেয়ে কাঁদছে তাকে কিছুই বলা যায় না। সাইফুদ্দিন সাহেব ঊর্মির দিকে তাকিয়ে বিব্রত গলায় বললেন, নাশতার কি হয়েছে দেখ তো মা।
এ-বাড়ির ভিতরের বারান্দায় লম্বা একটা ছয় চেয়ারের টেবিল আছে। কোন চেয়ারে কে বসবে তা নির্দিষ্ট করা। সাইফুদ্দিন সাহেব এবং বিজুবসে মুখোমুখি দুজন দুই প্রান্তে। বাকি চারটি চেয়ারের একটিতে ঊর্মি, অন্যটিতে জাহানারা। তারা বসে কোনোকুনিভাবে।
আজ দীর্ঘদিন পর নিয়ম ভঙ্গ হল। সোমা ভুল করে তার বাবার চেয়ারে বসে পড়েছে। সাইফুদ্দিন সাহেব অস্বস্তি বোধ করছেন। কিন্তু কিছু বলতে পারছেন না। নিজের চেয়ারে না বসলে তিনি ভালোমতো খেতে পারেন না। হাত রাখার জায়গাটা অপরিচিত লাগে। নির্দিষ্ট যে-কাঠের উপর ডান পা রাখেন সেই কাঠ না থাকায় পাটাকে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। তিনি আজ বসেছেন ঊর্মির চেয়ারে। কাজেই সব এলোমলো হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন পর বাবা এবং ছেলে বসল পাশাপাশি। দুজনের চেহারার মিল খুবই বেশি। বিজু বুড়ো হলে কেমন দেখতে হবে তা সাইফুদ্দিন সাহেবের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। সোমা লক্ষ করল দুজনেই রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসছে। যেন তাদের মধ্যে গোপন কোনো রহস্যের ব্যাপার আছে। বাইরে কড়ই গাছ কাটা হচ্ছে। করাত চালানোর শব্দ আসছে। পিতাপুত্র কাউকে গাছকাটা নিয়ে চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে না। ঊর্মি বলল, ভাইয়া গাছ তো কাটা শুরু করেছে।
বিজু হাসিমুখে বলল, কাটুক।
প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে সাইফুদ্দিন সাহেবও বললেন, কাটুক।
জাহানারা থমথমে গলায় বললেন, দিনে-দুপুরে ডাকাতি করবে কিছু বলবে না?
বিজু চায়ে চিনি মেশাতে মেশাতে বলল, না।
সাইফুদ্দিন গম্ভীর গলায় বললেন, আমরা কিছুই বলব না। কথা শেষ করেই তিনি বিজুর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেন। বিজু হাসল না। গম্ভীর গলায় বলল, গাছ কাটার পর খেলা জমবে। অপেক্ষা কর–আগে গাছটা কাটা থোক।
ঊর্মি বলল, মারামারি করবে?
বিজু বলল, না। কিছুই করব না। বসে বসে শুধু মজা দেখব। গাছ কাটা শেষ হবার পরপরই একটা মজার ব্যাপার হবে। মজার ব্যাপারটা কী বলে দেব বাবা?
বলে দে।
বিজু মজার ব্যাপার ব্যাখ্যা করল সোমার দিকে তাকিয়ে। ব্যাপারটা কি হয়েছে। আপা শোন, বিগ ম্যাঙ্গো করল কি…….
বিগ ব্যাঙ্গো কে?
বিগ ম্যাঙ্গো হচ্ছে আমাদের সম্মানিত বড় চাচা মুখটা ফজলি আমের মত তো তাই তার নাম বিগ ম্যাঙ্গো। যাই হোক, বিগ ম্যাঙ্গো কি করল শোন—অত্যন্ত গোপনে গাছ বিক্রির ব্যাপারটা এক লোকের সঙ্গে ফাইন্যাল করে ফেলল। চার হাজার টাকা। আসল দাম খুব কম হলেও আট হাজার। যাই হোক, আমি ঐ লোকের সাথে দেখা করলাম। তাকে একটা খুব খারাপ কথা বললাম, সেটা তোমাদের না শুনলেও চলবে। সঙ্গে তিন জন মস্তান নিয়ে গেলাম। গাছওয়ালার নাম কুদ্দুস। ভয়ে সে তখন প্যান্ট ভিজিয়ে দেয় স্টেইজে আছে। আমি বললাম, কুদ্দস মিয়া, গাছ কিনতে যাচ্ছ খুবই ভালো কথা। তবে গাছ আমার। টাকা তুমি আমাকে দেবে এবং এখন দেবে, তারপর গাছ কেটে নিয়ে যাবে। যার সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে তাকে বলবে গাছের টাকা দেওয়া হয়ে গেছে। আমি তোমাকে পাকা রসিদ দেব। তবে ঐ পার্টি যেন গাছ। কাটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু জানতে না পারে। ব্যাস, কাজ খতম। রসিদ দিয়ে টাকা নিয়ে এসেছি। বিগ ম্যাঙ্গোর অবস্থা কি হয় এটা দেখার জন্যে সারা দিন ঘরে বসে থাকব। হা-হা-হা। বিজু দুলে-দুলে হাসতে লাগল।