সোমা।
বল।
কাল কখন যাবে?
দশটা এগারটার দিকে।
ও আচ্ছা। আমি আটটার সময় চলে যাব। নারায়ণগঞ্জ যেতে হবে। ঘুম ভাঙলে হয়। শালার ঘুম ভাঙে না।
আমি সাতটার সময় ডেকে দেব।
নাশতা-টাশতার হাঙ্গামা করার দরকার নেই। চা খেয়ে চলে যাব। যাও ঘুমুতে যাও।
লোকটা সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে শোবার ঘরে চলে গেল। এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে কিন্তু তার কোন ছাপ তার আচার আচরণে নেই। যেন আজকের রাতটা অন্য আর দশটা রাতের মতোই। যেন সোমার সঙ্গে সামান্য কিছু কথা কাটাকাটি হয়েছে এবং মিটমাটও হয়ে গেছে। শাবার ঘর থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে। লোকটা দিনের শেষ সিগারেটটা ধরিয়েছে। খুক খুক করে কাশছে। সোমা সামনে থাকলে নিৰ্ঘাত বলত শালার সিগারেট। ধরা যায় না ছাড়াও যায় না। সিগারেট শেষ করে সে একটা কাঁচা রসুন খাবে। পুরোটা খেতে পারবে না। খানিকটা খেয়েই মুখ বিকৃত করবে। বিড় বিড় করে রসুনকে খানিকক্ষণ গালাগালি করবে।
সোমা চায়ের কাপ নিয়ে রান্না ঘরে চলে গেল। সব ধুয়ে রেখে যাবে। ময়লা অপরিচ্ছন্ন কিছু যেন না থাকে। রান্না ঘরটার জন্যে মায়া লাগছে। কেন লাগছে কে জানে।
সোমা।
সোমা শোয়ার ঘরে ঢুকল। লোকটা পা তুলে বুড়ো মানুষের মতো চেয়ারে বসে আছে। সিগারেট ফেলে দিয়েছে। পুরোটা খেতে পারে নি। ্কখনো পারে না।
সোমা।
বল।
অনেক দুঃখ কষ্ট তোমাকে দিয়েছি, কিছু মনে রেখ না। মনের মধ্যে রাগ রাখা ঠিক না। স্বাস্থ্যের খুব ক্ষতি হয়।
তোমার উপর আমার কোনো রাগ নেই।
আমারও নেই।
সোমা খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, আমি চলে যাব ভেবে তোমার কি খারাপ লাগছে?
না। তেল আর পানি কোনদিন মেশে না এটা ঠিক নামেশে, তবে খুব ঝাঁকাঝাঁকি করতে হয়। আমার ঝাঁকাঝাঁকি করতে ভালো লাগে না।
সোমা তাকিয়ে রইল। লোকা মাঝে মাঝে মজার কথা বলে। ফিলসফারের মতো কথা। সব মানুষের মধ্যেই বোধহয় একজন ফিলসফার থাকে। লোকটা চেয়ার থেকে নেমে মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল। নিচু গলায় বলল, ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। সারা দিন অনেক ধকল গিয়েছে। বিজুর মাথাটা এরকম গরম হল কেন বল তো? বিপদে পড়বে তো। দিনকাল খারাপ।
তুমি আজ রসুন খেলে না?
বাদ দাও শরীরটা ভালোনা। রসুন খেতে গেলে বমি হয়ে যাবে। বাতিটা নিবিয়ে দিয়ে যাও।
সোমা বাতি নিবিয়ে দিল। ঘর পুরোপুরি অন্ধকার হল না। পাশের ঘর থেকে আলো আসছে। বারান্দায় বাতি জ্বলছে। সোমা বলল, টাকা পয়সা সব স্টিলের আমিরায় আছে। চাবি টেবিলের ড্রয়ারে।
লোকটা কোনো উত্তর দিল না। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। সোমা বারান্দার বাতি নিবিয়ে দিল। অনেক দিন আর এই বারান্দায় আসা হবে না। আটটা ফুলের টব বারান্দায় সাজানো, দুটোতে আছে বকমভিলিয়া। টবে না-কি বকমভিলিয়া হয় না, তবু সে পরীক্ষা করার জন্যে লাগিয়েছে। দুটো গাছ বড় হয়েছে, এখনো পাতা ছাড়ে নি। কি রঙের পাতা ছাড়বে কে জানে। কাল এই টব দুটো সঙ্গে নিয়ে যাবে? না থাক। এ বাড়ির কিছুই সে নেবে না। এসেছিল খালি হাতে, ফিরেও যাবে খালি হাতে।
সোমা বসার ঘরে ঢুকল। বিড়ালটা আবার ফিরে এসেছে। লোকা যে চেয়ারে বসেছিল বিড়ালটাও ঠিক সেই চেয়ারে বসেছে। এক চোখে তাকিয়ে আছে সোমার দিকে। সোমা বিড়ালের সামনের চেয়ারে বসল। সে সারা রাত জাগবে। নিশি যাপনের জন্যে একজন সঙ্গী দরকার। পাশের ঘর থেকে লোকটার নিঃশ্বাসের ভারি শব্দ আসছে। চারদিকে সুনসা নীরবতা। সোমা জেগে আছে। বিড়ালটাও জেগে আছে। এক চোখে আগ্রহ নিয়ে দেখছে সোমাকে। এই বাড়ি ছেড়ে কাল ভোরে সে চলে যাবে। আর কোনোদিন ফিরে আসবে না, অথচ এজন্যে তার তেমন খারাপ লাগছে না। একটু খারাপ লাগা উচিত ছিল। কেন লাগছে না কে জানে।
টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে
টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ মেঘে ঢাকা। মেঘের রঙ ক্রমেই কালো হচ্ছে। মনে হচ্ছে সারা দিনই বৃষ্টি হবে। পর্দা ঢাকা রিকশা, তবু সোমা অনেকখানি ভিজে গেছে। খুব বিরক্ত লাগছে। ভেজা শাড়ি গায়ে লেপ্টে থাকবে আর সে নামবে রিকশা থেকে।
রাস্তা ভালো নাখানাখন্দ। একেক বার এমন ঝাঁকুনি খাচ্ছে মনে হচ্ছে সোমা উলটে পড়ে যাবে। সে কড়া গলায় বলল, আস্তে চালান না ভাই। মেয়েরা আস্তে চালাতে বললে রিকশাওয়ালারা সাধারণত খুব দ্রুত চালাতে শুরু করে। এখানেও তাই হল রিকশা চলল ঝড়ের গতিতে। প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছে সবকিছু নিয়ে রিকশা উলটে পড়বে। দ্বিতীয় বার রিকশাওয়ালাকে আস্তে চালানোর অনুরোধ করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। হোক একটা অ্যাকসিডেন্ট। সোমার ভাগ্যে অ্যাকসিডেন্ট যোগ আছে। ওর পঁচিশ বছরের জীবনে তিন বার সে রিকশা নিয়ে উলটে পড়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার কোনো বারই তার নিজের কিছু হয় নি। গায়ে সামান্য আচড়ও লাগে নি। অথচ রিকশাওয়ালা প্রতি বারই জখম হয়েছে। এক বার তো এক জন একেবারে মর মর। হাসপাতালে ছিল অনেক দিন। সোমা দুবার দেখতে গিয়েছে। রিকশাওয়ালার স্ত্রী খাটের কাছে বসে থাকত। সোমাকে দেখলেই বাঘিনীর মতো তাকাত, যেন সমস্ত দোষ সোমার।
আফা কোন বাড়ি?
পরের গলিটা দিয়ে ঢেকেন। সাবধানে যাবেন রাস্তা ভাঙা।
ভাঙা রাস্তায় সাবধানে গাড়ি চালাইলে অ্যাকসিডেন্ট বেশি হয় আফা।
বেশ তা হলে অসাবধান হয়েই চালান।
ঝিকাতলার এই বাড়ির অর্ধেক সোমাদের। সোমার দাদা গ্রামের সমস্ত জমিজমা বিক্রি করে ঢাকা শহরে দুতলা বাড়ি করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর দুই ছেলে বাড়ি পেয়ে গেল। দুজনেই মোটামুটিভাবে অপদার্থ। সোমার বাবা সাইফুদ্দিন সাহেব এল এম এফ ডাক্তার। দীর্ঘ দিনেও তাঁর কোনো পসার হল না। সারা দিন ডিসপেনসারিতে বসে থাকেন, একটা রুগী আসে না। এক ডিসপেনসারির মালিক তো এক দিন বলেই বসল, আপনি ভাই অপয়া মানুষ। অন্য কোথাও গিয়ে বসেন। ডাক্তারের কাছে রুগী না এলে ওষুধপত্র বিক্রি হয় না। বুঝলেন না?