বড় চাচা ভীষণ হৈ চৈ করছেন। তিনি কিছুতেই যাবেন না। ক্রমাগত বলছেন—ওরা আমাকে নিয়ে মেরে ফেলবে। খুনীর দল আমাকে নিয়ে মেরে ফেলবে। আমাকে নিয়ে খুন করবে। খুন করতে নিয়ে যাচ্ছে।
মিথির দুই মামা খুবই বিরক্ত হচ্ছেন। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। গাড়ির দুই ড্রাইভার তাঁর হাত ধরে তাঁকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। তিনি গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছেন। তাঁকে ঘর থেকে বের করতে ড্রাইভার দু জনকে খুব বেগ পেতে হল।
মিথির বড় মামা বিরক্ত গলায় বললেন, এই সামান্য কাজে তোমরা সারা দিন লাগিয়ে দিচ্ছ। হাত দুটা শক্ত করে ধর না কেন?
বাড়ি থেকে বের করে আনার পর বড় চাচা কিছুক্ষণের জন্যে চিৎকার করলেন। তারপর শিশুদের মতো শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন। বিজুকে ডাকতে শুরু করলেন, ও বিজু, বিজুওরা আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ও বিজু,–বিজু…..। আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বিজু…….ওরা আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
মিথির ছোট মামা বললেন, এক জন কেউ মুখটা চেপে ধর। চিৎকার সহ্য করা যাচ্ছে না। আহ, কি—যে যন্ত্ৰণা।
বড় চাচাকে পিকআপে ওঠানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। ড্রাইভার দু জন পেরে উঠছে না। সাহায্যের জন্যে মিথির বড় মামা এগিয়ে গেলেন। বড় চাচা ফুঁপিয়ে ডাকতে লাগলেন, ও বিজু, বিজু…….
বিজু বেরিয়ে এল। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল বড় চাচার দিকে। তারপর গর্জন করে উঠল, একটা মানুষ যেতে চাচ্ছে না, তারপরও আপনারা তাঁকে জোর করে নিয়ে যাবেন? পেয়েছেন কী আপনারা? মগের মুলুক নাকি?
বড় চাচা কান্না থামিয়ে উঁচু গলায় বললেন, ঘুষি মেরে ওদের নাক ফাঁটিয়ে দে বিজু। কথায় কাজ হবে না। কথার মানুষ এরা না।
বিজু বলল, যান, রেখে আসুন।
মিথির বড় মামা বললেন, কি বলছ তুমি? চিকিৎসা করাতে হবে না? এখানে চিকিৎসাটা কে কবে?
আমরা করব। আমরা কি পানিতে ভেসে গেছি নাকি? একটা লোক ভয় পাচ্ছে, যেতে চাচ্ছে না, তবু তাকে নিয়ে যাবেন। পেয়েছেনটা কী?
বড় চাচা বললেন, খামাখা কথা বলে সময় নষ্ট করছিস বিজু। ঘুষি দিয়ে নাক। ফাটিয়ে দে। এরা কথার মানুষ না।
বিজু বলল, যান রেখে আসুন। নইলে অসুবিধা হবে। পাড়ার লোক ডেকে থোলাই দিয়ে দেব।
বড় চাচা আনন্দে হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতে বললেন, দেরি করিস না, ধোলাই দিয়ে দে। রাম থোলাই দিয়ে দে।
বড় চাচাকে আবার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিথি মিথিরা গাড়িতে উঠে বসেছিল, তারা নেমে আসছে। মালপত্র নামানো হচ্ছে। ঊর্মি বারান্দায় আছে।
বিজু একদিন ইলেকট্রিশিয়ানের সামনে তার গালে চড় মেরেছিল—এই অপরাধের জন্যে কোনোদিন সে বিজুকে ক্ষমা করবে না বলে ভেবে রেখেছিল। আজ ক্ষমা করল। সে এগিয়ে গেল জিনিসপত্র নামানোর কাজে বিজুকে সাহায্য করবার জন্যে। বড় চাচা এখন বেশ স্বাভাবিক। তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। সেখান থেকে চেচিয়ে বলছেন, কাচের জিনিস আছে। আস্তে নামা! এরা কোন একটা কাজ যদি ঠিকমতো করতে পারে। বিজু উৰ্মিটাকে একটা ধমক দে তো—কি রকম টানাটানি করছে। ভাঙবে না?
সোমা নতুন বই নিতে এসেছে
সোমা নতুন বই নিতে এসেছে। তিনি বই বেছে দিচ্ছেন। সোমা দেখল একটা কুচকুচে কালো বিড়াল তাঁর পায়ে গা ঘষছে।
সোমা বলল, এই বিড়ালটা কি আপনার?
না। বেড়াল আমার পছন্দের প্রাণী না। তবে আমার স্ত্রী পছন্দ করত। বেড়ালকে খেতেটেতে দিত। এই কালো বেড়ালটা হচ্ছে আমার স্ত্রীর পোষা বেড়ালগুলোর কোনো একটা বংশধর।
আপনি কি একে খেতেটেতে দেন?
হ্যাঁ দিই। আমার স্ত্রীর প্রতি মমতা থেকে দিই। এমনিতে কিন্তু কুকুর-বেড়াল কোনোটাই আমি পছন্দ করি না।
আমিও করি না।
তিনি হাসতে হাসতে বললেন, লোকে বলে যারা পাখি পছন্দ করে তারা পশু পছন্দ করে না। তুমি কি পাখি পছন্দ কর সোমা?
জানি না, করি বোধহয়।
আজ এই বইটা নিয়ে যাও, প্রথম এক শ পাতা কষ্ট করে পড়তে হবে তারপর দেখবে–হাত থেকে বই নামাতে পারছ না।
সোমা জবাব দিল না। সে কালো বিড়ালটার দিকে একদৃষ্টিতে কি যেন দেখছে। সোমা চাপা গলায় বলল, ও বিড়াল খুব পছন্দ করে। বলেই সে অসম্ভব লজ্জা পেয়ে গেল।
তিনি অবাক হয়ে দৃশ্যটি দেখলেন। নরম স্বরে বললেন, উনি বেড়াল পছন্দ করতেন?
জ্বি। এক বার রাস্তা থেকে একটা বিড়াল ধরে নিয়ে এসেছিল। পিঠে ঘা হয়েছিল, তাই রোজ ডেটল দিয়ে ঘা ধুয়ে দিত। পুঁজ পরিষ্কার করত। আমার গা ঘিন ঘিন করত। ভাত খেতে পারতাম না। বিড়ালটা অবশ্যি বাঁচে নি। সাত দিনের দিন মরে গেল।
উনি খুব কষ্ট পেয়েছিলেন মনে হয়।
হ্যাঁ, হাউমাউ করে কিছুক্ষণ কাঁদল। তার পরপরই অবশ্যি খুব স্বাভাবিক। ওর কষ্ট বেশিক্ষণ থাকে না।
সোমা?
জ্বি।
তুমি কিন্তু এখনো ঐ ভদ্রলোককে খুব পছন্দ কর।
সোমা চুপ করে রইল।
তিনি নরম স্বরে বললেন, এস আমরা বাইরে খানিকক্ষণ বসি।
তারা বারান্দায় এসে বসল। তিনি একটা সিগারেট ধরিয়ে সহজ গলায় বললেন, সোমা, আমার মনে হয় তোমার ঐ ভদ্রলোকের কাছে ফিরে যাওয়া উচিত। তাঁকে আরেকটা সুযোগ দেওয়া উচিত।
সে কেমন মানুষ আপনি কিছুই জানেন না বলে এটা বলতে পারলেন।
ধরে নিলাম খুবই খারাপ মানুষ। কিন্তু তুমি তাকে বদলাবার কোনো চেষ্টা কি করেছ? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তুমি কর নি। করে দেখ না।
সোমা তাকিয়ে আছে কোনো কথা বলছে না।
তিনি বললেন, চা খাবে?
সোমা বলল, না।
তিনি ভারি গলায় বললেন, তোমাকে ওঁর কাছে ফিরে যেতে বলছি কেন জান, ঐ মানুষটার জন্যে তোমার তীব্র ভালবাসা আছে, কিন্তু তুমি সেটা বুঝতে পারছ না।