এখানে তো বেশ বাতাস সোমা।
জ্বি।
দাঁড়াই খানিকটা গায়ের ঘাম মরুক, কী বলিস?
দাঁড়াও।
তিনি ইতস্তত করে বললেন, তোকে একটা কথা বলা হয় নি। প্রফেসর সাহেবের বাসায় গিয়েছিলাম। মানে এমনি হঠাৎ ভাবলাম….হাজার হলেও প্রতিবেশী। তাই না?
তা তো ঠিকই।
ভদ্রলোককে যেরকম ভেবেছিলাম সেরকম না। খুবই ভদ্রলোক। ধরতে গেলে আমি তাঁর ব্যবহারে মুগ্ধ। তোর মাকে বলেছি সেকথা। খুবই ভালো মানুষ। পাড়াতেও খুবই সুনাম।
ভালো মানুষ, সুনাম কেন হবে না বল?
নিরহঙ্কারী লোক। এক দিন পানি ছিল না, উনি নিজেই রাস্তার মিউনিসিপ্যালিটির কল থেকে বালতি করে পানি নিয়ে গেলেন। সবাই পারে না। সঙ্কোচ বোধ করে। তাই না?
তা ঠিক।
সম্মান যার আছে সে সম্মান যাওয়ার ভয় করে না। যার সম্মান নেই তার যত ভয়।
তোমার গায়ের ঘাম বোধহয় মরেছে, চল ভেতরে যাই।
দাঁড়া আরেকটু। বাতাসটা ভালোই লাগছে। সোমা, প্রফেসর সাহেব একটা প্রস্তাব দিয়েছেন, মানে—ইয়ে—তোর মা কি কিছু বলেছে তোতাকে?
না।
আচ্ছা তোর মার কাছ থেকে শুনিস। প্রস্তাবটা আমার পছন্দ হয়েছে। একটা ফ্ৰেশ স্টার্ট হলে ভালো হয়। বেশ ভালো হয়। চেঁচামেচি কে করছে রে?
বড় চাচা।
যন্ত্রণা হল দেখি।
সাইফুদ্দিন সাহেব বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে ফেললেন।
রাত বারটা দশ। বিজু এখনো ফেরে নি। মাঝেমাঝে সে খুব রাত করে। তার না কি পার্টি মিটিং থাকে। আজও বোধহয় পার্টি মিটিং ছিল। জাহানারা ভাত বেড়ে ক্লান্ত হয়ে অপেক্ষা করছিলেন।
সোমা বলল, তুমি ঘুমিয়ে পড় মা। আমি জেগে আছি। আমি সন্ধ্যাবেলায় ঘুমিয়েছি। এখন আর ঘুম আসছে না।
জাহানারা সঙ্গে-সঙ্গে ঘুমুতে গেলেন। বাড়ি নিঝুম হয়ে গেল। বড় চাচার কথাও শোনা যাচ্ছে না। সম্ভবত তিনিও ঘুমুচ্ছেন। মাঝেমাঝে একটা ঘুমন্ত বাড়িতে একা একা জেগে থাকতে ভালো লাগে। অদ্ভুত-অদ্ভুত সব চিন্তা আসে। আজ অবশ্যি তেমন কোনো অদ্ভুত চিন্তা সোমার মাথায় আসছে না। সে প্রফেসর সাহেবের রেখে যাওয়া বইটি কোলে নিয়ে বসে আছে।
এই ভদ্রলোককে সে কখনো কোনো নামে ডাকে নি। প্রথম পরিচয়ের দিন এক বার শুধু স্যার বলেছিল। উনি বলেছিলেন, সবার মুখে দিনরাত স্যার-স্যার শুনি। তুমি স্যার না বললে কেমন হয়?
সোমা বলেছিল, কী ডাকব?
তোমার যা ইচ্ছা তাই ডাকতে পার।
সোমা কিছু ডাকে নি।
দরজার কড়া নড়ছে। সোমা খুলে দিল। লজ্জিত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকল বিজু।
দেরি করলাম আপা। সরি। পার্টি মিটিং ছিল।
তরকারি গরম করব, না যেমন আছে তেমনি খাবি?
কিছু খাব না আপা। বিরিয়ানি খেয়ে এসেছি।
চা খাবি? চা করে দেব?
দাও। বেশি করে বানিও। ফ্লাস্কে ভরে রাখব।
সোমা রান্নাঘরে চা বানাচ্ছে। বিজু কাপড় ছেড়ে সিগারেট হাতে এসে বসল ববানের পাশে।
সোমা চায়ে চিনি মেশাতে মেশাতে বলল, বিজু, ও নাকি রাতের বেলা বাসার সামনে দিয়ে হাঁটা হাঁটি করে?
কে বলেছে তোমাকে?
করে কি না বল।
আর করবে না। হেভি ধাঁতানি দিয়ে দিয়েছি।
মারধর করেছিস?
আরে না। তুমি কি ভাবো আমি রাতদিন মারামারি করে বেড়াই? আমি লোকটাকে কঠিন করে বলে দিয়েছি—আপনাকে তিন রাত এখানে হাঁটাহাঁটি করতে দেখেছি। আর যেন না দেখি। মামদোবাজি আমি সহ্য করব না।
সোমা শীতল গলায় বলল, এক জন লোক যদি বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যায়, তা হলে তোর অসুবিধা কী?
বিজু খুব অবাক হল।
সোমা বলল, এমন তো না যে সে কারোর কোনো ক্ষতি করছে।
ও একটা ক্রিমিন্যাল লোক আপা। বল, ক্রিমন্যাল না?
সোমা চুপ করে রইল।
বিজু বলল, একটা কথা সত্যি করে বল তো আপা, তুমি ওর কাছে ফিরে যেতে চাও?
না।
কখনো কি তোমার মনে হয়েছে যে, চলে এসে তুমি ভুল করেছ?
না।
শুনে ভালো লাগল আপা। তোমার কাণ্ডকারখানায় মাঝে-মাঝে কনফিউজড হয়ে যাই।
সোমা বলল, তুই যখন ঐ সব কথা ওকে বললি, তখনও ও কী বলল?
তুমি এখনো ও সব নিয়ে ভাবছ?
কী বলল ও?
কিছুই বলে নি।
এখানে আসত কেন, জিজ্ঞেস করেছিলি?
না। কথা বলার অবস্থা ছিল না।
কেন?
মাথায় ব্যাভেজফ্যাভেজ দেখলাম। কেউ বোধহয় হেভি পিটন দিয়েছে।
সোমার হাত থেকে চা ছলকে পড়ল।
বিজু বলল, ঠাট্টা করছিলাম আপা। তোমার রিঅ্যাকশন দেখছিলাম। লোকটা বহাল তবিয়েতেই আছে। তবে মার একদিন সে খাবে। পাবলিক তাকে পিটিয়ে লম্বা বানাবে। তোমার শুনতে খারাপ লাগলেও কথাটা সত্যি।
সোমা উঠে দাঁড়াল।
বিজুও উঠল। সোমার পিছনে পিছন আসতে আসতে বলল, তুমি খুব শক্ত মেয়ে, তবে তোমার আরো শক্ত হওয়া দরকার।
তোকে উপদেশ দিতে হবে না।
উপদেশ দিচ্ছি না আপা; আর শুধু একটা কথা বলব। তোমার ঐ প্রফেসর ভদ্রলোক-খারাপ না। ভালো। তুমি যদি এঁর বাসায় যাও, আমি রাগ করব না। বরং খুশিই হব। শুধু আমি একা না, এ-বাড়ির সবাই খুশি হবে।
বড় চাচাকে নিয়ে যেতে
বড় চাচাকে নিয়ে যেতে মিথির দুই মামা এসেছেন।
বাড়ির সামনে একটা পিকআপ এবং একটা ডাইহাট গাড়ি দাঁড়িয়ে। পিকআপে জিনিসপত্র ভোলা হচ্ছে। ব্যাপারটা ঊর্মি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখল। তার খুব খারাপ লাগল। সে ভেতরে এসে বিজুকে বলল, ওরা সবকিছু নিয়ে চলে যাচ্ছে।
বিজু বলল, যাক না। তোর এত মাথাব্যথা কীসের?
মিথি-তিথিরা খুব কান্নাকাটি করছে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখার কোন দরকার নেই। বড় আপা কোথায়?
ঐ বাড়িতে।
যা, আপাকে ডেকে নিয়ে আয়।
ঊর্মি বলল, আমি পারব না। এইরকম কান্নাকাটির মধ্যে আমি যাব নাকি?