কলেজে যাওয়ার পথে সে মুরাদকে প্রথম এক ঝলক দেখতে পায়। সে আমজাদের চায়ের দোকানে বসেছিল। বিজুকে দেখেই চট করে সরে পড়ল। বেশি দূর যেতে পারল না। বিজু ছুটে গিয়ে ধরে ফেলল, পর মুহূর্তেই প্রচণ্ড এক চড় বসাল। এমন প্ৰচণ্ড চড় যে, মুরাদ উলটে পড়ে মাথায় চোট খেল। এক ভদ্রলোক আঁতকে উঠে বললেন, করেন কি?
বিজু বলল, কি করছি দেখতে পাচ্ছেন না, আর দিচ্ছি। আপনার বাসা থেকে টাকা নিয়ে পালালে আপনি কি করতেন? কোলে নিয়ে চুমু খেতেন? কি চুমু খেতেন কোলে নিয়ে?
ভদ্রলোক কথা বললেন না। বিজু মুরাদের চুল ধরে টানতে টানতে বাসায় নিয়ে এল। তার মূর্তি ভয়ঙ্কর। ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে। মাঝে-মাঝে হিংস্র গলায় বলছে, তোর বাপের নাম ভুলিয়ে দেব। এত বড় সাহস। বাজারের টাকা নিয়ে উধাও। মামদোবাজি?
সোমা ব্যাপার দেখে স্তম্ভিত। এক জন মানুষ অন্য এক জনকে এমনভাবে মারতে পারে? সোমা বলল, এই সব কী হচ্ছে?
বিজু বলল, আদর হচ্ছে। হারামজাদাকে আদর করছি।
সোমা কড়া গলায় বলল, ছাড়—ওর চুল ছাড়।
তুমি এখান থেকে যাও তো আপা।
তুই ওর চুল ছাড়।
বললাম তো–তমি এখান থেকে যাও।
ওকে ছেড়ে দে বিজু।
তুমি বড় যন্ত্রণা করছ আপা।
তুই ওকে না ছাড়লে আমি এই মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।
বিজু চুল ছেড়ে ছিল। সোমা বলল, তুই এসব কী শুরু করেছিস?
চোরকে ধরে কয়েকটা চড় দিয়েছি, এর বেশি কী করলাম?
বড় চাচাকে তুই কী বলেছিস?
বড় চাচার কথা এখানে আসছে কেন?
তুই কী বলেছিস বড় চাচাকে?
কী বলব, কিছুই বলি নি।
কিছুই বলিস নি তা হলে উনি এরকম করছেন কেন?
কীরকম করছেন?
তাও জানিস না?
তুমি বড় চেঁচামেচি করছ আপা। এত চেঁচামেচি করার তো কিছু হয় নি, তুমি অনেক কিছু করছ যা আমার পছন্দ না। কিন্তু কই আমি তো চেঁচামেচি করছি না। আমি তো চুপ করে আছি।
সোমাচাপা স্বরে বলল, আমি কী করেছি?
ঐ হারামজাদা প্রফেসরের বাসায় তুমি যাও নি? এত কিছুর পরও তো গিয়েছ। হেসে হেসে গল্পগুজব করেছ। কর নি?
জাহানারা বের হয়ে এলেন। কঠিন স্বরে বললেন, যথেষ্ট হয়েছে। বিজু ঘরে যা।
বিজু ঘরে ঢুকে গেল। হাত-মুখ ধুয়ে সহজ-স্বাভাবিক গলায় বলল, চা দে তো ঊর্মি। আজ ক্লাসটা মিস হয়ে গেল। ইম্পৰ্টেন্ট ক্লাস ছিল। তুই কলেজে যাস নি কেন রে?
কলেজ বন্ধ।
আজ আবার কীসের বন্ধ? যন্ত্রণা হল দেখি। দুই দিন পর পর বন্ধ? তোদর কলেজের অবস্থা তো দেখি আমাদেরটার চেয়েও খারাপ।
বিজু সহজ ভঙ্গিতে কথা বলছে। একটু আগের ঘটনার কোনো ছাপ তার মধ্যে নেই। আবার কলেজের দিকে রওনা হবার আগে সে সোমাকে বলল, আপা, তোমার টবের এই গাছ দুটা চমৎকার। বগনভিলিয়ার এত সুন্দর কালার হয় জানাই ছিল না। একসেলেন্ট।
সোমা জবাব দিল না।
বিজু নিচু গলায় বলল, মাঝে-মাঝে হট ব্রেইনে কি বলে ফেলি কিছু মনে রেখ। না আপা। আর ঐ পিচ্চিকে পাঁচটা টাকা দিয়ে দিয়েছি। দেখ গিয়ে ও দাঁত বের করে হাসছে। মারধরে ওদের কিছু হয় না। মারধর ওদের ডাল ভাত।
দুপুরে সোমা বড় চাচাকে দেখতে গেল। তিথি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, বাবার বোধহয় মাথাই খারাপ হয়ে গেছে আপা। ঐদিন বিজু ভাই কি-সব বলে গেছেন। তারপর থেকে……
সোমা বলল, চাচি নেই?
মা সাত দিন আগে রাগারাগি করে ঐ যে বড় মামার বাসায় গেছেন আর আসছেন না। কী করি বল তো আপা?
বড় চাচার অবস্থার কথা চাচি জানেন?
জানেন। আমি নিজে গিয়ে বলেছি।
চাচি কী বললেন?
কিছুই বলেন না।
সোমা বড় চাচার ঘরে ঢুকল। তিনি একদৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, কে, সোমা না?
জ্বি।
ভালো আছিস মা?
জ্বি ভালোই তো?
শরীরটা ভালো তো?
জ্বি ভালো।
শরীরটা ঠিক রাখবি। শরীর ঠিক রাখাটা খুবই দরকার। শরীরটা নষ্ট হয়ে গেছে—তাই আমার এই অবস্থা। শরীর ঠিক থাকলে তিথির তিন মামাকে কি করতাম দেখতে পেতিস। ধরে ধরে আছাড় দিতাম। তিনটাই বদ। মহা বদ। দুটো কাঁচাপয়সার মুখ দেখে মনে করছে দুনিয়া কিনে ফেলেছে। দুনিয়া কেনা এত সস্তা না। ফেরাউন বাদশা কিনতে পারে নি। তার তো টাকার অভাব ছিল না। ব্যাটা তোদের কটা টাকা হয়েছে বল দেখি? দুটো ব্যাঙের আধুলি পেয়ে মনে করেছিস কি? তোদের মুখে আমি পেচ্ছাব করে দিইইয়েস পেচ্ছাব। স্ট্রেট পেচ্ছাব করে দেব। তখন বুঝবি কত ধানে। কত চাল? তোরা ভেবেছিস কী? দুই মণ ধানে দুই মণ চাল? উঁহু, এত সহজ না। দুই মণ ধানে এক মণ চাল–খুব বেশি হলে দেড় মণ……
বড় চাচা অনবরত কথা বলে যাচ্ছেন। এক মুহূর্তের জন্যেও থামছেন না। তিথি ও মিথি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে তাদের মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। মিথি হাত ইশারা করে সোমাকে ডাকছে।
সোমা উঠে গেল বড় চাচার কথা বলা বন্ধ হল না। তিনি কথা বলেই যাচ্ছেন। মিথি বলল, কি করব আপি?
বড় চাচিকে নিয়ে আয়। কিংবা তোর কোনো মামাকে আন। ভয় নেই আমি এখানে আছি।
বাবা কি পাগল হয়ে গেছেন?
আরে না, মানুষ এত সহজে পাগল হয় না। মাথাটা গরম হয়েছে। ওষুধপত্র খেলে ঠিক হয়ে যাবে। যা তোরা দুজনে মিলে চলে যা।
মিথিরা চলে যাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় চাচা বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। বেশ আরামের ঘুম। তাঁর নাক ডাকতে লাগল।
সোমা পাশেই বসে রইল। তার কিছুই করার নেই। একটা বই হাতের কাছে থাকলে বসে বসে পড়া যেত। অনেক দিন বই পড়া হয় না। বই পড়তে কেমন লাগবে এখন কে জানে। বিকেলের দিকে একবার কি যাবে বই আনতে? না থাক। যন্ত্ৰণা বাড়িয়ে লাভ নেই। এমনিতেই অনেক যন্ত্ৰণা।