সোমা।
বল।
শালিকে এখন থেকে রোজ খানিকটা দুধ দেবে। এই সময় খাওয়াটা ভালো দরকার। তিন মাস পরপর পেট হয়ে যাচ্ছে। কি অবস্থা দেখা
লোকটা শব্দ করে ঢেকুর তুলল। বাটিতে সামান্য যা ডাল ছিল চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেলল। গোঁফে হলুদ রঙের ছোপ। সোমা এক বার ভাবল, বলবে গোঁফে ডাল লেগেছে। শেষ পর্যন্ত আর বলল না।
চা দাও সোমা, খাওয়া হয়ে গেছে। আজকের মতো একসেলেন্ট ডাল অনেক দিন খাওয়া হয় নি। মাছের একটা মাথা যদি দিতে পারতে তা হলে দেখতে কি জিনিস হত।
সোমা চা দিতে এসে দেখে লোকটা মেঝেতে উবু হয়ে বসে আছে। বিড়ালের দুধ খাওয়া দেখছে। এখন হাত দেয়া হয় নি। ডাল শুকিয়ে হলুদ দাগ পড়েছে।
চা নাও।
শালির দুধ খাওয়ার কায়দাটা দেখেছ? কেমন ঘুরে ঘুরে খায়। অদ্ভুত কাণ্ড।
সোমা দাঁড়িয়ে রইল। সে বিড়ালের দুধ খাওয়া দেখছে না। লোকটাকে দেখছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই যাকে সে অত্যন্ত কঠিন কিছু কথা বলবে। কঠিন কথাগুলো শুনে সে কি করবে কে জানে, চায়ের কাপ ছুঁড়ে ফেলবে? চিৎকার চেঁচামেচি করবে? গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে? কিছুই বলা যাচ্ছে না। বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে একটা মানুষ কেমন আচরণ করে তা বলা খুবই কঠিন।
চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
শালি কেমন ঘুরে ঘুরে দুধ খায় দেখেছ? ইন্টারেস্টিং। ভেরি ইন্টারেস্টিং।
সোমা সহজ স্বাভাবিক, স্বরে বলল, হাত-মুখ ধুয়ে তুমি বসার ঘরে একটু আসবে? তোমার সঙ্গে খুব জরুরি কিছু কথা আছে।
লোকটা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে সোমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সে কি কিছু আঁচ করতে পারছে? মনে হয় না। আঁচ করতে পারলে থমথমে গলায় বলত কি জরুরি কথা? সে কিছুই না বলে বাথরুমে হাত-মুখ ধুতে ঢুকল। বাথরুম থেকেই চেচিয়ে বলল, চা খাব না। একটা পান দাও।
সোমাদের বসার ঘরটা ছোট। এই ছোট ঘরের একটা অংশে মিনু শুয়ে আছে। বার বার এ-পাশ ও-পাশ করছে। জ্বর বেড়েছে বোধহয়। অন্য সময় হলে সোমা মেয়েটার জ্বর দেখত। ঘুম ভাঙিয়ে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করত। আজ তা করল না। জরুরি কথাগুলো শেষ হোক। তারপর যদি সুযোগ হয় তখন দেখা যাবে।
বসার ঘরে চারটা বেতের চেয়ার। মাঝখানে গোল টেবিলে ধবধবে সাদা টেবিল কথ। টেবিল ক্লথের ঠিক মাঝখানে লাল রঙা পিরিচে পান। সাদা, লাল এবং সবুজ রঙ কি সুন্দর লাগছে।
লোকটা সোমার সামনের চেয়ারে বসল। তার চোখ লালচে। রাতের বেলা তার চোখ লালচে হয়ে থাকে। ভোরবেলা আবার সাদা হয়ে যায়। বাঁ চোখ অবশ্যি সাদা হয় না। লালচে আভা খানিকটা থেকেই যায়। ছোট বেলায় নাকি বাঁ চোখে চোট খেয়েছিল।
পান দাও।
লোকটা পান নিতে নিতে কঠিন চোখে তিন চার বার তাকাল। আজ তার চোখ অন্য দিনের চেয়েও লাল মনে হচ্ছে। না-কি এটা সোমার মনের ভুল?
সোমা!
বল।
তোমার কোনো জরুরি কথা বলার দরকার নেই। জরুরি কথা আমি জানি। বিজু এসেছিল—ও সব কথা বলল।
কখন এসেছিল?
দুপুরের দিকে রহমতের চায়ের স্টলে।
রহমতের চায়ের স্টলে লোকটা রোজ এক বার যায়। দুপুরের দিকেই যায়। ঐ স্টলে তার শেয়ার আছে কিন্তু বিজুর তো তা জানার কথা না। জানল কি করে?
সোমা পান খায় না। তখন একটা মুখে দিল। জৰ্দা দেওয়া পান। পানের কষটা পিকে মুখ ভরে যাচ্ছে। মাথা ঝিম্ ঝিম করছে। জর্দার রসে মুখ ভর্তি হয়ে আসছে। ফেলার উপায় নেই। ফেলতে হলে উঠে যেতে হবে। এখন ওঠা সম্ভব না।
বিজু যা করছে বলার না। চেঁচামেচি হৈ চৈ। আমি বললাম, ভদ্রলোকের ছেলে চেঁচাচ্ছ কেন? এতে তার রাগ আরো বেড়ে গেল। লোকজনের সামনে ইতর ছোটলোক, জেলের ঘুঘু এইসব বলেছে।
সোমা বিব্রত স্বরে বলল, বিজুর মাথা সবসময় গরম। ওকে কেউ তোমার কাছে। যেতে বলে নি। নিজে নিজেই গিয়েছে।
গিয়েই ভালো করেছে। না গেলে জানতাম যে তুমি আজ ডিভোর্স পেয়ে বসে আছ? বিজুর কারণে জানলাম।
তুমি তো জানতে যে আমি ডিভোর্স চেয়ে চিঠি দিয়েছি। জানতে না?
হ্যাঁ জানতাম। ব্যাপারগুলো এত তাড়াতাড়ি হয় জানতাম না। এক বার কোর্টে যেতে হল না, কিছু না–হঠাৎ শুনি ডিভোর্স।
এইসব কেইস কোর্টে যায় না।
তাইতো দেখছি। ব্যাপারটা এত সহজ আমি জানতাম না।
জানলে কী করতে?
করতাম আর কি? করার কি আছে?
বিজু কি খুব হৈ চৈ করেছিল?
করেছিল মানে? দেখার মতো একটা দৃশ্য। লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি বলে কি-তুই জেলের ঘুঘু, চামারের চামার। জেল যখন খেটেছি জেলের ঘুঘু তো বলবেই।
তুই তোকারি কেন?
ওর মাথা গরম।
মাথা আমারও গরম। আমার কি মাথা ঠাণ্ডা? মাথা ঠাণ্ডা হলে চার বছর জেল। খেটে আসি? ঠাণ্ডা মাথায় কটা লোক জেলের ভাত খায়?
তোমার মাথা অনেক ঠাণ্ডা।
সমাজে চলতে ফিরতে হয় এই জন্যে ঠাণ্ডা রাখি। আসলে ঠাণ্ডা না। তুমি এতসব ঝামেলা না করে আমাকে গুছিয়ে বললেই হত।
বললেই তুমি আমাকে চলে যেতে দিতে?
যে থাকতে না চায় তাকে ধরে রাখা যায়? আমার কি জেলখানা আছে যে তোমাকে জেলখানায় আটকে রাখব?
সোমা খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, কাগজপত্র দেখতে চাও?
কাগজ দেখে কি হবে?
কিছু হবে না, তবু যদি দেখতে চাও।
দূর দূর।
লোকটা হাই তুলল। কী আশ্চর্য! এই অবস্থায় কেউ হাই তুলতে পারে? সত্যি সত্যি কি লোকটার ঘুম আসছে? নাকি সে ভান করছে। না, ভান নিশ্চয়ই করছে না। লোকটা ভান করতে পারে না। আচ্ছা এই লোক কি নির্বোধ? কারণ একমাত্র নির্বোধরাই ভান করতে পারে না। সাদা বিড়ালটা এসে লোকটার পায়ে গা ঘষছে। আঙুল কামড়ে ধরছে। বড় ঝামেলা করছে। মাঝে মাঝে বিড়ালটা খুব বিরক্ত করে—তখন লাথি খায়। আজও নিশ্চয়ই লাথি খাবে। কিংবা কে জানে হয়তো লাথি খাবে না। আজকের রাতটা আর অন্য দশটা রাতের মতো নয়। লোকটি আবার হাই তুলল; চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। লাথির ভয়েই হয়তো বিড়ালটা ছুটে পালিয়ে গেল।