সাইফুদ্দিন সাহেব মাটিতে বসে পড়লেন। পরের তিন মাস তিনি মেয়ে-জামাইয়ের কোনো খোঁজ বের করতে পারলেন না। তিন মাস পর খুলনা থেকে মেয়ের চিঠি পেলেন
বাবা,
আমি ভালো আছি। আমাকে নিয়ে তোমরা দুশ্চিন্তা করবে না। ইতি,
তোমাদের
সোমা।
পুনশ্চ: মাকে সালাম দিও। বিজু এবং ঊর্মিকে আদর।
কামালের চোখের অবস্থা খুব খারাপ
কামালের চোখের অবস্থা খুব খারাপ হয়েছে। আগে মাঝে-মাঝে পানি পড়ত, এখন ক্রমাগত পড়ে। রোদে বের হলে যন্ত্রণা হয়। চিনচিনে ব্যর্থ হয়। ঘন কালো রঙের চশমা একটা সে কিনেছে। সেই চশমা চোখে দিলে দিনে-দুপুরে ঢাকা শহর অন্ধকার হয়ে যায়। কাউকে চেনা যায় না। এও এক যন্ত্ৰণা।
ঢাকা শহরে প্রতিটি লোকের মুখের দিকে তাকিয়ে পথ হাঁটতে হয়। চিনে চিনে। পথ চলা। এখন সেটা সম্ভব হচ্ছে না। পথ চলতে হচ্ছে অন্ধের মত। তার মতো মানুষের জন্যে এটা খুবই বিপজ্জনক।
একদিন দুপুরে গুলিস্তানের মোড়ে তাকে পিছন থেকে কে যেন ডাকল, কে কামাল সাহেব না?
এইসব ক্ষেত্রে কামাল কখনো মাথা ঘুরিয়ে পিছন দিকে তাকায় না। দ্রুত সরে পড়তে চেষ্টা করে। সেদিনও তাই করল। প্রায় লাফ দিয়ে চলন্ত একটা বেবিট্যাক্সিতে উঠে পড়ল। বেবিট্যাক্সিওয়ালা তার দিকে ফিরতেই বলল, তাড়াতাড়ি যাও। পিজি। পেটে ব্যথা উঠেছে। মরে যাচ্ছি।
বেবিট্যাক্সিওয়ালা ঝড়ের গতিতে বেবিট্যাক্সি পিজিতে নিয়ে এল। কামাল ভাড়া মিটিয়ে শিশুপার্কের দিকে হাঁটা ধরল। বেবিট্যাক্সিওয়ালা তাকিয়ে রইল হতভম্ব হয়ে। পেটে ব্যথার রুগী শিশুপার্কে যায় কেন?
ঢাকা শহরে কামালের চেনা লোকের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এটা তার জন্যে খুবই খারাপ। বছর চারেকের জন্যে এই শহর ছেড়ে অন্য কোথায়ও চলে যাওয়া দরকার। মুশকিল হচ্ছে যেতে ইচ্ছা করছে না। আলস্য এসে গেছে। বেশিরভাগ সময় এখন সে ঘরেই থাকে। খবরের কাগজ পড়ে। ঘুমায়। কিছু জমা টাকা আছে, এইগুলি শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে এইভাবেই থাকবে। ঝামেলায় যেতে ইচ্ছা করে না। রোজ সন্ধ্যাবেলা সোমার জন্যে তার কেন জানি খুব খারাপ লাগে। মনে হয়, মেয়েটা বড় ভালো ছিল। আমার সঙ্গে থেকে খুব কষ্ট করে গেল।
সোমার কেমন যেন শীত শীত লাগছে
সোমার কেমন যেন শীত শীত লাগছে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে বোধহয়। ফ্যানের শো-শোঁ শব্দে কিছুই শোনা যাচ্ছে না। বিজু ফ্যানটা ভালো কেনে নি। এত শব্দ হবার তো কথা না।
সোমা উঠে বসল।
পাশের খাটে ঊর্মি। কেমন এলোমেলল ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। ঊর্মির জীবনটা কেমন হবে কে জানে! এই ব্যাপারটা আগেভাগে জানা থাকলে ভালো হত। নিজেকে প্রস্তুত করে রাখা যেত। পৃথিবী বড় রহস্যময় জায়গা। সব রহস্যে ঢাকা। আগে থেকে কিছুই জানা যায় না।
স্যান্ডেল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সোমা খালি পায়েই দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল। বৃষ্টি পড়ছে ঠিকই। বিজু শুয়েছে বারান্দায়। বৃষ্টির ছাট লাগছে গায়ে। তবু ঘুম ভাঙছে না। সে এসে বিজুকে বিপদে ফেলে দিয়েছে। নিজের ঘর ছেড়ে বেচারাকে ঘুমুতে হচ্ছে বারান্দায়।
সোমা ডাকল, এই বিজু।
বিজু সঙ্গে-সঙ্গে জবাব দিল, কি আপা?
জেগেছিলি নাকি?
হুঁ।
বৃষ্টিতে ভিজছিস তো, ভেতরে গিয়ে ঘুমো। আমি ঊর্মির সঙ্গে শোব।
দু এক ফোঁটা পানিতে আমার কিছু হয় না আপা।
বলতে বলতে বিজু মশারির ভেতর থেকে বের হয়ে এল। হাত বাড়িয়ে বালিশের নিচ থেকে সিগারেটের প্যাকেট, দেশলাই বের করল। সোমা তাকিয়ে আছে। কত ছোট দেখেছে তাকে। ঘরময় হামাগুড়ি দিত। একটু পর পর বলত হাঁউ। এই ছেলে বয়স্ক লোকের ভঙ্গিতে মুহুর্তে সিগারেটের প্যাকেট বের করে। কায়দা করে ধোঁয়া ছাড়ে।
আপা।
কি।
এ বাড়িতে রাতে তোমার ভালো ঘুম হচ্ছে না—তাই না?
হবে না কেন, হয়।
একটু পর-পর বিছানা থেকে ওঠে। পানি খাও। বারান্দায় হাঁটাহাঁটি কর। আবার গিয়ে শোও।
তুই এতসব দেখিস কখন? জেগে থাকিস?
হুঁ।
তোরও ঘুম হয় না?
হয়। তবে কম হয়। আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে নানান চিন্তা করি।
কি চিন্তা-ভাবনা? দ্রুত কীভাবে বড়লোক হওয়া যায়।
এখনি মাথায় এই চিন্তা?
হুঁ। এখনি। এবং দেখবে আমি হয়ে ছাড়ব। পুতু-পুতু লাইফ অসহ্য। বি এ পাশ করে পড়াশোনা স্টপ করে দেব। তারপর..
তারপর কি?
এখন বলব না। আছে অনেক পরিকল্পনা। প্রথম পরিকল্পনা হচ্ছে—বড় চাচার উচ্ছেদ। কীরকম কায়দা করে এটা করি সেটাই শুধু দেখো।
ছিঃ বিজু ছিঃ।
বিজু কোনো উত্তর করল না। নিজের মনে হাসল। সোমা বারান্দায় রাখা চেয়ারে বসল। বৃষ্টি দেখতে তার ভালো লাগছে।
চা খাবে নাকি আপা? ফ্লাস্কে চা আছে। খেতে পার। দেব?
দে।
বিজু উঠে চা ঢালল। আপার জন্যে এবং তার নিজের জন্যে।
আপা।
বল।
ঐখানে তুমি অনেক কষ্ট করেছ। আর তোমাকে কষ্ট করতে দেব না। তোমার ঝামেলাটা যখন হয় তখন আমি ছোট ছিলাম। আমার বয়স একটু বেশি হলে ঘটনা অন্যরকম হত।
তুই বিরাট দায়িত্ববান হয়েছিস মনে হয়।
হ্যাঁ হয়েছি। তোমাদের ভালো লাগুক বা না লাগুক দায়িত্ববান কিন্তু হয়েছি। বিজু চুপ করে গেল। সে বৃষ্টি দেখছে। বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ছে। একটা ব্যাঙ লাফিয়ে বারান্দায় উঠেছে। এখন ঢুকতে চাচ্ছে। বিজু তা দেখেও চুপ করে আছে। সোমা মৃদু গলায় বলল, বিজু।
বল।
ঐ প্রফেসর সাহেব কি এখন আছেন? মানে ঐ যে……
জানি কার কথা বলছ। হ্যাঁ আছেন।
ঐ বাড়িতেই?
হুঁ।
কেমন আছেন—তুই কিছু জানিস?