বিয়েতে সোমা খুশিই হয়েছিল।
সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল বিয়ের রাতে কামালের ব্যবহারে। সে তার স্ত্রীকে বিয়ের রাতে কোনোরকম বিরক্ত করে নিহাই তুলে বলেছে, সকাল-সকাল ঘুমিয়ে পড়। রাত থাকতে উঠতে হবে, দিনে-দিনে চিটাগাং পৌঁছাতে হবে। বিরাট যন্ত্রণা চিটাগাংয়ে ফেলে এসেছি। বিয়েটা তিনদিন পরে করলে আরাম করা যেত। বলেই লোকটা শুয়ে পড়ল। আর শোয়ার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ঘুম। কিছুক্ষণের মধ্যে লোকটার নাক ডাকার শব্দ শোনা যেতে লাগল। কোনো আদর না। কোনো গল্প না। ভালবাসার কোনো কথা না। সোমা সারারাত খাটের এক মাথায় কাঠ হয়ে বসে রইল। তার সারাক্ষণ ভয় ভয় করছিল—এইবুঝি লোকটা জেগে বলবে, এই এদিকে আসতো। লোকটার চোখে থাকবে অন্য ধরনের আহ্বান।
সেরকম কিছুই হল না।
খুব ভোরে ফার্স্ট বাস ধরে তারা চলে এল ঢাকায়।
কামাল বলল, চল তোমাদের বাসায় যাই। চা-টা খেয়ে গোসল-টোসল করে চিটাগাংয়ের বাস ধরি।
সোমা বলল, আমি বাবার বাড়িতে যাব না।
লোকটা অবাক হয়ে বলল, যাবে না কেন?
ইচ্ছা করছে না।
ইচ্ছা না করলে দরকার নেই। জোর-জবরদস্তির কোনো ব্যপার না। জোর-জবরদস্তি আমার কাছে নাই।
দুই কামরার একটা বাসায় তাদের বিবাহিত জীবন শুরু হল। দামপাড়ায় বাসা। বাসার কাছেই মসজিদ। মাইক বাজিয়ে সারাদিন সেই মসজিদে ওয়াজ হয়। লোকটা দাঁত বের করে বলল, দিনরাত আল্লাহ-খোদার নাম শুনবে। নামাজ রোজা ছাড়াই সোয়াব হবে। বাসা পছন্দ?
সোমা পুরুষ-পুরুষ গন্ধের সেই ঘরের বিছানায় চুপচাপ বসে রইল। পছন্দ-অপছন্দের কিছুই তার তখন নেই। পৃথিবীর সবকিছুই তার পছন্দ আবার সবকিছুই তার অপছন্দ।
চা বানাতে পার? শিখেছ এইসব?
সোমা তাকিয়ে রইল। কি-রকম অমার্জিত ভঙ্গিতে কথা বলছে লোকটা। এই কথাগুলো কি আরো সুন্দর করে বলা যায় না?
যাওচা বানাও, রান্নাঘরে জিনিসপত্র আছে। চা খেয়ে হেভি গোসল দিব। তারপরে দিব ঘুম। শালা ঘুম কারে বলে দেখবে। ঘুম নাম্বার ওয়ান। হা-হা-হা।
সোমা চা বানিয়ে আনল। লোটা হাঁটুর ওপর লুঙ্গি তুলে খালি গায়ে বসে আছে। দৃশ্যটা যে কি পরিমাণ কুৎসিত সে বোধহয় জানেও না।
লোকটা বলল, তোমার জন্য চা আনলে না?
আমি চা খাই না।
না খেলে কি আর করা। না খেলে নাই। বস আমার সামনে, দু একটা কথা বলি।
সোমা বসল।
লোকটা চুক চুক করে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, তোমার কিছু সমস্যা আছে, আমি জানি। এও জানি সমস্যাটা ভালো না। সমস্যা আছে বলেই আমার মতো ছেলের সাথে তোমার বিয়ে হল। আমি কচি খোকা না। আল্লাহতায়ালা আমাকে কিছু বুদ্ধি দিয়ে পাঠিয়েছেন। এই জিনিস অনেককে তিনি দেন না। যাই হোক, এখন আমি কি বলছি মন দিয়ে শোন। তোমার কি সমস্যা আছে আমি জানতে চাই না। হয়ে গেছে শেষ হয়ে গেছে। গু কাটি দিয়ে ঘাঁটলে গন্ধ ছড়ায়। গন্ধের আমার দরকার নাই। তোমার যেমন কিছু সমস্যা আছে আমারও আছে। আগে একটা বিয়ে করেছিলাম। বিয়ে টিকে নাই। এই কথা তোমার আত্মীয়-স্বজনেরে বলি নাই। আগ বাড়িয়ে সব কথা বলার দরকার কি? তুমি যদি জানতে চাও বলব। জানতে না চাইলে বলব না। তারপর ধর…
সোমা তার কথা শেষ করতে দিল না। কথার মাঝখানেই স্পষ্ট করে বলল, আমার কোনো সমস্যা নেই।
লোকটা বিস্মিত কণ্ঠে বলল, কি বললে তুমি?
আমার কোনো সমস্যা নেই।
না থাকলে তো ভালো। কাছে আস।
সোমা কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে কাছে এগিয়ে গেল।
বস।
সোমা বসল।
লোকটা হাতের সিগারেট দূরে ছুঁড়ে ফেলে খুবই সহজ ভঙ্গিতে সোমার বুকে হাত রাখল। সোমা কাঠ হয়ে গেল। লোকটা বলল, যাও জানালাগুলো বন্ধ করে দাও।
সোমা তাকিয়ে রইল। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে কিছুই বিশ্বাস করতে পারছে। না।
যাও জানালাগুলো বন্ধ কর। লজ্জার কিছু নাই।
সোমা উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করল। তার অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে। এই মানুষটার সঙ্গে তার বাকি জীবন কাটাতে হবে? কেন? সে এমন কি অপরাধ করেছে?
সোমাদের ঢাকা পৌঁছানোর সাত দিনের দিন সাইফুদ্দিন সাহেব মেয়েকে দেখতে এলেন। মেয়ের ছোট্ট এবং গোছানো সংসার দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন। জামাইয়ের জন্যে দামি একটা ঘড়ি এবং পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে এসেছিলেন। ঘড়ি এবং টাকা দিয়ে জামাইকে ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক কথাই বললেন যার তেমন কোন অর্থ নেই। কামাল নত মস্তকে সব শুনল এবং প্রতিবারই বলল, অবশ্যই। যা বলেছেন সবই খাঁটি কথা। একটাও ফেলে দেবার কথা না।
জামাইয়ের ব্যবহারে তিনি মুগ্ধ হলেন। তাঁর কাছে মনে হল—ছেলেটার বয়স একটু বেশি হলেও সে অতি নম্ৰ, অতি ভদ্ৰ।
ঢাকায় ফিরে আসার আগে সোমাকে জিজ্ঞেস করলেন, জামাই কি করে সেটাতো বুঝলাম না? ছেলে করে কি?
সোমা ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগল।
সাইফুদ্দিন সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। ব্যাপারটা কি?
কামাল তার শ্বশুরকে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছিল। সাইফুদ্দিন সাহেব ট্রেন ছাড়ার আগ মুহূর্তে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা, তুমি কি কর ঠিক বুঝলাম না। ব্যবসা?
কামাল দাঁত বের করে হাসল। জবাব দিল না।
সাইফুদ্দিন সাহেব গভীর দুশ্চিন্তা নিয়ে ঢাকায় ফিরলেন। লম্বা চিঠি লিখলেন মেয়েকে। কোনো উত্তর পেলেন না। আবার লিখলেন, তার উত্তর নেই। তিনি আবার চিটাগাং গেলেন, সোমারা ঐ বাড়িতে নেই। কোথায় গেছে কেউ বলতে পারে না।
বাড়িওয়ালা বলল, ঐ লোক আপনার কি হয়? বিরাট ফক্কড় লোক। তাকে বাড়ি ভাড়া দিয়ে বিরাট যন্ত্রণায় পড়েছি। দু দিন পরে-পরে পুলিশ এসে খোঁজ করে। বাড়িটার বদনাম হয়ে গেছে।