জাহানারা একদিন বললেন, তোর চেহারা এমন খারাপ হয়েছে কেন? তোর কি কোনো অসুখ-বিসুখ হয়েছে?
বুঝতে পারছি না।
তোর বাবাকে দেখিয়ে ওষুধ-টষুধ খা। তোর দিকে তো তাকানো যাচ্ছে না।
সাইফুদ্দিন সাহেব মেয়েকে দেখে টেখে বললেন, লিভারের কোনো সমস্যা। হজমে গণ্ডগোল হচ্ছে। একটা ডাইজেসটিভ এনজাইম দিচ্ছি। ওতেই কাজ হবে। আর শোন মা, তুই রাতদিন মুখের ওপর বই নিয়ে পড়ে থাকবি না, একটু হাঁটাহাঁটি করবি। এক্সারসাইজের দরকার আছে। খুব ভোরবেলা উঠে খানিকক্ষণ ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ করবি।
সেই সময় ঘটনাটা ঘটল।
খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, ঐদিনের দুপুরটা ছিল সোমার কল্পনার দুপুরের মতো মেঘলা-বাতাস ছিল মধুর। ঐ বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ৰূপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়তে লাগল। সোমা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজল। যোক-সবকিছু কল্পনার মতো হোক।
ভদ্রলোকই দরজা খুলে দিয়ে বিস্মিত হয়ে বললেন, এই বৃষ্টির মধ্যে? বাবা বইয়ের তো দেখি ভালো নেশা ধরে গেছে।
সোমা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, বাসায় আর কেউ নেই।
তিনি বললেন, থাকবে না কেন? সবাই আছে। এসো। আজ দেখি শাড়ি পড়ে এসেছ। ভেরি গুড। শাড়ি হচ্ছে একটা এলিগ্যান্ট ড্রেস। এবং এই ড্রেসের সবচেয়ে বড় বিউটি কি জান?
জ্বি না।
পৃথিবীর অন্য সব ড্রেসের সমস্যা হচ্ছে একজনেরটা অন্যজনের গায়ে লাগে না। দরজি দিয়ে বানাতে হয়। শাড়িতে এই সমস্যা নেই। কি ঠিক বলি নি?
হ্যাঁ ঠিক।
তুমি আজ এত গম্ভীর হয়ে আছ কেন বল তো? কি হয়েছে?
কিছু হয় নি।
জ্বর-জারি না তো?
জ্বি না।
সাবধান থাকবে। এখন খুব অসুখ বিসুখ হচ্ছে। এস আজ আমি নিজেই তোমাকে পছন্দ করে বই দেব। এস।
তারা লাইব্রেরি ঘরে ঢুকল।
ঘরটা এমনিতেই অন্ধকার অন্ধকার। আজ আকাশ মেঘলা থাকায় আরো যেন বেশি অন্ধকার লাগছে। সোমার কেমন যেন লাগছে। বুক শুকিয়ে কাঠ, অসম্ভব তৃষ্ণাবোধ হচ্ছে। খুব ইচ্ছে করছে মানুষটার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াতে।
কি ব্যাপার সোমা এত ঘামছ কেন? তুমি বস তো এই চেয়ারটায় আমার মনে হচ্ছে তোমার শরীর ভালো না। দাঁড়াও ফ্যানটা ছেড়ে দিচ্ছি।
সোমা কাতর গলায় বলল, আমি বাসায় যাব।
তিনি বিস্মিত হয়ে তাকালেন। আর ঠিক তখনি পাশের ঘর থেকে অরুণা তীব্র ও তীক্ষ্ণ গলায় চেচিয়ে উঠল, তোমরা ঐ-ঘরে কি করছ? তোমরা ঐ-ঘরে কি করছ? তোমরা দুজন ঐ-ঘরে কি করছ?
ভদ্রলোক হতভম্ব হয়ে তাকালেন সোমার দিকে। তারপরই শান্ত ভঙ্গিতে স্ত্রীর ঘরে ঢুকে ভারী গলায় বললেন, এরকম করছ কেন অরুণা? ছিঃ, এসব কি? আমার স্বভাব-চরিত্ৰ তুমি জান না?
অরুণা আকাশ ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগলেন, আমি দেখেছি। আমি দেখেছি। আমি জানি তোমরা কি করছ। আমি জানি। আমি জানি।
কাজের মেয়েটি ছুটে এল। একতলার ভদ্রমহিলা ছুটে এলেন। পাশের ঘরের জানালা খুলে গেল। বাড়ির সামনের গেটে দুজন পথচারী থমকে দাঁড়ালেন। হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মানুষের মতো অরুণা চেঁচাচ্ছেন, আমি জানি, আমি জানি।
সোমা ছুটে বের হয়ে গেল।
এরকম ঘটনা এ-পাড়ায় অনেকদিন ঘটে নি। সাইফুদ্দিন সাহেবের বাসার সামনে দেখতে দেখতে লোক জমে গেল। নিতান্ত অপরিচিত লোকজন দরজায় কড়া নেড়ে জিজ্ঞেস করতে লাগল, মেয়েটাকে ওরা কি করেছে বলেন দেখি ভাই। ঐ হারামজাদার আমরা চামড়া খুলে ফেলব।
প্রফেসর সাহেবের ঐ দোতলা বাড়ির চারদিকে ছেলেপুলে জমে গেল। ঢিল পড়তে লাগল—সেই সঙ্গে কুৎসিত গালাগাল—তলে তলে ফুর্তি। রস বেশি হয়ে গেছে। আয় হারামজাদা রস বের করে দিই।
সন্ধ্যার পর শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে পাড়ায় পুলিশ চলে এল। সাইফুদ্দিন সাহেব সেই রাতেই মেয়েকে খালার বাড়ি টাঙ্গাইলের বড় বাসালিয়ায় পাঠিয়ে দিলেন। খালার সেই পাঁচিল ঘেরা বড়ি ছিল দুর্গের মতো। সোমার মনে হল এই দুর্গ থেকে কোনোদিন সে বেরুতে পারবে না। দু মাস পর সাইফুদ্দিন সাহেব মেয়েকে ঢাকায় নিয়ে এলেন। সোমার দিকে তখন তাকানো যায় না। চোখ বসে গেছে। মাথার সামনের দিকের চুল খানিকটা উঠে গেছে। কথা বাৰ্তাও কেমন অসংলগ্নভাবে বলে।
জাহানারা মেয়েকে দেখে কেঁদে ফেললেন।
পাড়ার মেয়েরা রোজ দল বেঁধে আসে। নানান কথা বার্তার পর একসময় বলে, কৈ, মেয়ে এসেছে শুনলাম। মেয়েকে লুকিয়ে রেখেছেন কেন? লুকিয়ে রাখার দরকার কি?
তারা নিজেদের মধ্যে চোখে-চোখে কথা বলেন। সেই চোখের ভাষা জাহানারা পড়তে পারেন। তিনি আতঙ্কে শিউরে ওঠেন।
পাড়ার মেয়েরা নিজেদের মধ্যে প্রকাশ্যেই আলোচনা করে, পেট নামিয়ে এসেছে। দেখলেই বোঝা যায়। কোন আনাড়িকে দিয়ে কাজ করিয়েছে কে জানে-দেখেন না মেয়ের কি অবস্থা? প্রায় মেরে ফেলতে বসেছিল।
একদিন সন্ধ্যায় সোমা কি জন্যে যেন বাইরের বারান্দায় গিয়েছে—দুটি ছেলে তাকে দেখে শিশুদের কান্নার নকল করে ওঁয়া ঔয়া করতে লাগল। সোমা মাকে গিয়ে বলল, মা, ওরা এমন করছে কেন? জাহানারা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তার পরেরদিন আবার তাকে টাঙ্গাইল পাঠিয়ে দেওয়া হল। জাহানারা তাঁর বোনকে লিখলেন—আপা, তুমি যেভাবেই পার আমার এই মেয়েটাকে একটা বিয়ে দিয়ে দাও। কানা, খোঁড়া, অন্ধ যাই হোক। তুমি এটা কর, আমি তোমার কাছে হাতজোড় করছি। আমার মন কেমন করছে। মনে হচ্ছে এই মেয়ের কোনোদিন বিয়ে হবে না। আপা, তুমি আমাদের বাঁচাও।
পৌষ মাসে সোমার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ে টাঙ্গাইলে হল, খুব তাড়াহুড়ার বিয়ে বলে কাউকে খবর দেওয়া গেল না। বিয়েতে বাবা-মা কিংবা ভাই-বোনেরা কেউ আসতে পারল না।